"সংগ্রহপাড়া" ভ্রমন করতে আসার জন্য আপনাকে স্বাগতম।

রবিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১১

ডারউইনের ঈশ্বর

ডারউইনের ঈশ্বর
লিখেছেন: জাহেদ আহমদ | বিভাগ: উদযাপন, ডারউইন দিবস, ধর্ম, বিজ্ঞান, বিবর্তন তারিখ: ১ ফাল্গুন ১৪১৫ (ফেব্রুয়ারি 13th, 2009)
(উৎসর্গ- বন্যা আহমেদকে, “বিবর্তনের পথ ধরে” বইটির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষীদের পথচলা সুগম করে তুলতে তাঁর অনবদ্য প্রচেষ্টার জন্য।)


একঃ
দূরদর্শনের অতি উৎসাহী গসপেল প্রচারক জিমি সোয়াগার্ট ১৯৮৫ সালে তাঁর দর্শক-শ্রোতাদের বিমোহিত করে ফেলেন একটি ঘোষণার মাধ্যমে। তিনি জানান যে, মৃত্যুশয্যায় ডারউইন পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলেন। বিবর্তন বিষয়ে নিজের তত্ত্বকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন; এমনকি মারা যাবার পূর্বে একখন্ড বাইবেল চেয়েছিলেন যাতে যীশুর প্রেমে আবার মজতে পারেন। পরে জানা গেল, ওটি ছিল ডাহা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি রটনা। সর্বপ্রথম এই অপপ্রচারের শুরু ১৮৮২ সালে যখন স্যার জেমস হোপ (এডমিরাল অব দ্য ফ্লিট)এর স্ত্রী প্রচার করেন, তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত ডারউইনকে নাকি আফসোস করে বলতে শুনেছেনঃ “আমার বিবর্তনের তত্ত্ব লোকজনকে ওভাবে না জানালেই পারতাম!” এ অপপ্রচারে ক্ষুদ্ধ হন ডারউইনের মেয়ে। তিনি স্পষ্ট করে জানান যে, লেডি হোপ ডারউইনের মৃত্যুশয্যা তো দূরের কথা, কোন অসুস্থতার সময়ই উপস্থিত ছিলেন না। ডারউইনের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটার সম্ভাবনা ও খুব ক্ষীণ। আর দৈবাতক্রমে তা ঘটে থাকলে ও ডারউইনের ওপর লেডী হোপের কোনই প্রভাব ছিল না। ডারউইনের মেয়ে সকল সংশয় ও বিভ্রান্তি নিরসনে এটা ও বললেন যে, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কিংবা তার ও আগে, ডারউইন কখনোই নিজের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং মতামতসমূহ পরিত্যাগ করেননি। মারা যাবার পূর্বে ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন ডারউইন। তাঁর সর্বশেষ উক্তি ছিল “আমি মৃত্যু নিয়ে এতটুকু ও ভীত নই।“



ধর্ম ও ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের অবস্থান নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল এই যে, জীবদ্দশায় ডারউইন কখনোই নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা দেননি। বিষয়টি চরমপন্থী নাস্তিক এবং বদ্ধমনা বিশ্বাসী- উভয়ের জন্যই খানিকটা অসুবিধার। তাই বলে ধর্ম ও ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের অবস্থান হেয়াঁলিপূর্ণ- এ কথা বলার সুযোগ নেই। পরিণত বয়সে লেখা আত্নজীবনীতে এসব বিষয়ে ডারউইন খোলাখোলি বক্তব্য দিয়েছেন। স্বঘোষিত নাস্তিক না হলে ও পরিণত বয়সে পৌঁছে ডারউইন যে প্রচলিত ধর্মে আস্থা হারিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। তাঁর আত্নজীবনীর ভাষায়, “চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছার পূর্বপর্যন্ত খৃস্ট ধর্ম আমি মোটে ও পরিত্যাগ করিনি।“ বলাবাহুল্য, ১৮৪৯ সালে ডারউইন চল্লিশ বছরে পা দেন। তবে ধর্মের সাথে বিচ্ছেদ ডারউইনের জন্য মোটে ও সহজ ছিল না এবং সেটা হঠাৎ করে ঘটেনি। মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পিতা রবার্ট এবং পিতামহ ইরাসমাস-এর খ্যাতি থাকলে ও ডারউইন নিজে প্রথম জীবনে একজন যীশুবিশ্বাসী খৃস্টান ছিলেন। কেম্ব্রিজে তিনি পেলি(Paley)’-র প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। তখন অবধি তাঁর জীবনে এমন কিছু ঘটেনি যাতে তিনি ঈশ্বর, যীশু বা বাইবেলে অনাস্থা প্রকাশ করতে পারেন। কেম্ব্রিজ থেকে পাশ করার পর তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির ছিল যে তিনি একজন যাজক হবেন। তাঁর স্ত্রী এভা (রক্ত সম্পর্কে মামাতো বোন) ও ছিলেন ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী একজন মানুষ ।



১৮৩১ সালে বাইশ বছরের তরুণ ডারউইন যখন এইচএমএস বিগ্‌ল জাহাজে চড়েন, তখন তাঁর কোন ধারণা ছিল না যে, ঐতিহাসিক এ সমুদ্রযাত্রা কেবল তাঁর নিজের জীবনের মোড় নয়, মানব জাতির নিজেদের ইতিহাস এবং ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্কের ভীত- এসব কিছুই নাড়িয়ে দেবে। বিগ্‌লে চড়ার সময় নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপাতির মাঝে ডারউইন সাথে নিয়েছিলেন একখন্ড বাইবেল। ধর্ম-দর্শনের প্রশ্নে তখন ও তিনি ছিলেন ঈশ্বরের ‘অমোঘ ও অলংঘনীয়’ বিধানে বিশ্বাসী। তাঁর সে সময়ের সাদামাটা বিশ্বাসের মধ্যে ছিলঃ প্রকৃতিতে সবকিছুর একটা চূড়ান্ত পরিণতির রয়েছে (অর্থাৎ তিনি ছিলেন পরিণতিবাদি); প্রকৃতির অপার লীলার আড়ালে রয়েছে মহাপ্রতিভাবান ও মহাসৃজনশীল কারো হাত (জ্বী-হ্যাঁ, তিনি নিজে ও ছিলেন একদা সৃষ্টিবাদী বা ক্রিয়েশনিস্ট) এবং প্রকৃতির সবকিছু আসলে ঈশ্বরের বিধানেরই প্রমাণ। “বিগলে আরোহন করার পরপর্যন্ত ও আমি ছিলাম খুবই রক্ষনশীল ধরনের। মনে পড়ে জাহেজের বহু অফিসার(যাঁরা নিজেরা ও রক্ষণশীল ছিলেন) আমাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন যখন নৈতিকতা বিষয়ে কোন কোন সময় আমি বাইবেলের বক্তব্যকে প্রশ্নাতীত হিসেবে উদ্ধৃত করতাম“ (ডারউইন আত্নজীবনী)।



দু বছরের সমুদ্রযাত্রা পাঁচ বছরে গিয়ে ঠেকে। ১৮৩৬ সালে বিগ্‌ল যখন ইংল্যান্ডের বন্দরে ফেরত আসে, ডারউইন তখন ১৮০ ডিগ্রী এংগেলে পালটে যাওয়া একজন মানুষ। কি ঘটেছিল বিগ্‌ল যাত্রার পাঁচ বছরে যা ডারউইনকে পুরোপুরি পালটে দিল? এ প্রসঙ্গে আমার লেখা ‘ডারউইন যে ভাবে বিজ্ঞানী হলেন’ প্রবন্ধের কিছু অংশ তুলে ধরছিঃ

বিগ্‌ল জাহাজে পাঁচ দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রাকালীন সময়ে ডারউইন জীবনে প্রথম বারের মত প্রত্যক্ষ করেন পাহাড় ও অন্যান্য ভূ-তাত্ত্বিক বস্তুর গায়ে বিবর্তনগত পরিবর্তনের চিহ¡। বিখ্যাত গেলাপাগস দ্বীপপুঞ্জ (ডারউইন ছিলেন সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করেন) থেকে সংগ্রহ করেন হরেক রকমের জীবাশ্ম, ছোট-বড় উদ্ভিদ ও প্রাণির নমুনা। তাঁর সংগৃহীত অনেক জীবাশ্মই ছিল অবলুপ্ত প্রাণিসমুহের এবং ডারউইন জানতে প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন কি কারণে ঐ সব প্রাণি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ¡ হয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন প্রাণিকুলের মধ্যে বিরাজমান অংগসংস্থান ও অন্তর্গত তন্ত্রসমুহের পার্থক্য। বিশাল আকারে আর ও সংগ্রহ করেছিলেন হরেক প্রজাতির ফিংগে পাখি। এ সময় ক্যাপ্টেন ফিজ্‌রয়ের দেয়া চার্লস লিয়েল নামক জনৈক ভূ-তত্ত্ববিদের লেখা ’প্রিন্সিপলস্‌ অব জিওলজি’ বইটি বিশেষভাবে তাঁর অধ্যয়নে কাজে লাগে। ………। দেশে এসে বছরের পর বছর সংগ্রীহিত নমুনা নিয়ে একাগ্রচিত্তে অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যান ডারউইন। সে সময় তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে শিকারী প্রাণি, দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর ভূমিকা সম্পর্কিত তত্ত্ব অবগত ছিলেন এবং এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। ভিতরে ভিতরে অধ্যয়ন ও গবেষণা পুরোদমে চালিয়ে গেলে ও বহু বছর চার্লস ডারউইন তাঁর থিওরীর কথা কাউকে জানাননি।“



দুইঃ

বিগ্‌লযাত্রা পরবর্তী সময়ে ডারউইন এ কথা বুঝে গেছেন যে, বাইবেলের জেনেসিসে বর্ণিত সর্বমোট ছয়দিনে ঈশ্বর কর্তৃক পৃথিবী এবং জীবকূল সৃষ্টির কাহিনী ভ্রান্ত। বিষয়টি তাঁর নিজের জন্য ও স্বস্তিকর ছিল না। সারা জীবনের লালিত বিশ্বাসকে চুরমার করে দিল চাক্ষুস ও অনস্বীকার্য প্রমাণপাতি আর উপাত্ত যা তিনি সংগ্রহ করেছেন নিজ হাতে। মোহভংগের বেদনা কাটাতে এ সময় তিনি ডিয়িজম (deism) বা একাত্নবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন । এ মতবাদে বিশ্বাসীরা ঈশ্বর প্রশ্নে প্রচলিত ধর্মসমূহের গোড়াঁমি ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে চলেন, তথাপি তাঁরা মনে করেন, জগতের ভারসাম্য বা ঐক্যতান কেবলমাত্র দৈব ঘটনার ফল নয়। তবে শেষ অবধি নিজের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’ বা থিওরী অব ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্যেই ডারউইন উত্তর খুঁজে পান সৃষ্টি সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের। ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরী তাঁকে এমন একটি আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় সন্ধান দিল যা একইসাথে জগতের ভারসাম্য ও শৃংখলা তৈরী করতে এবং তা অব্যাহত রাখতে সক্ষম।



আস্তে আস্তে খৃস্ট ধর্ম ও বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর থেকে ডারউইন নিজেকে গুটিয়ে নেন। ভিতরে ভিতরে বাইবেলে*১ বর্ণিত ঈশ্বরের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের বক্তব্যের সাথে পরবর্তীকালের কৃতি বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক আলবার্ট আইন্সটাইনের বক্তব্যের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। নিজেদের সরাসরি নাস্তিক ঘোষণা না দিলে ও এঁদের দুজনেই এমন কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানতে রাজী হননি যিনি কি-না সর্বশক্তিমান এবং সর্বাধিক দয়ালু অথচ নির্দেশ অমান্যকারী (যেমনঃ সংশয়ী, অবিশ্বাসী) সৃষ্টিকূলকে তিনি কঠিন, ভয়াবহ এবং নির্মম নরকযন্ত্রণা দিতে পছন্দ করেন। তথাকথিত অলৌকিকত্ব বা মিরাকলে ও এঁদের আস্থা ছিল না। তবে ধর্ম ও ঈশ্বর প্রসংগে ডারউইনের বক্তব্য কেবল বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিবর্তনের আলোকে তিনি ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসের ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা করেন। বাইবেলের Old Testament এ বর্ণিত পাষাণ ও নিষ্ঠুর ঈশ্বর এবং নৈতিকতা বিষয়ে খৃস্টান ধর্মের যে ব্যাখ্যা- ডারউইনের মতে এ সব বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের আদিম সত্ত্বার শেষ চিহ্ন। জীবের বাঁচার সংগ্রাম, কষ্ট, ভোগান্তির কারণ ও অস্তিত্বের ব্যাখ্যা ‘সর্বদয়ালু এবং সর্বশক্তিমান’ কোন বিধাতার স্থলে নৈতিক বিচারে অন্ধ প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথেই বেশি মানানসই। তাঁর মতে, ধর্মের ইতিহাস স্বয়ং একটি বিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। প্রাণিদের পর্যবেক্ষন করে ডারউন তাদের মধ্যে কিছু সর্বপ্রাণবাদী (animist) আচরনের অস্তিত্ব লক্ষ করলেন যাকে তিনি ধর্মবিশ্বাসের এক প্রকার আদিম প্রকাশ বলে মত ব্যক্ত করেন। ডারউইন বিশ্বাস করতেন, নৈতিকতার মত ধর্ম ও বিবর্তনের একটি প্রোডাক্ট বা সৃষ্টি মাত্র ; ঐশী বাণী ব্যতিরেকে ও ধর্মের ধাপসমূহ এবং বিধিমালার পুনর্সন্ধান এবং পুনরাবিষ্কার সম্ভব।





তিনঃ

ধর্ম, নৈতিকতা এবং ঈশ্বর বিষয়ে ডারউইনের মনোজগতে এসব দৃষ্টিভংগিসমূহের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছিল খুবই ধীর গতিতে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত আত্নজীবনীতে ডারউইন কথাটি বলেন এ ভাবেঃ “(ধর্মে) অবিশ্বাসের বীজ আমার মধ্যে খুবই ধীরগতিতে অংকুরিত হতে থাকে, তবে শেষের দিকে সেটা পূর্ণতা পায়।“ জীবদ্দশায় ধর্ম-ঈশ্বর নিয়ে প্রকাশ্যে যে কোন বাক-বিতন্ডা তিনি এড়িয়ে চলতেন। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে- ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের আগেভাগেই ইংল্যান্ডের রক্ষনশীল খৃস্টানদের বিরাগভাজন হতে চাননি তিনি। এ ছাড়া ঘরে তাঁর স্ত্রী এভা ছিলেন ধর্মবিশ্বাসে সম্পূর্ণ অন্য মেরুর মানুষ। তবে স্ত্রীর নিজের মত করে বিশ্বাসের অধিকারকে ডারউইন শ্রদ্ধা করে গেছেন জীবনভর। যা হোক, দীর্ঘ দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে নিজেকে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ রচনায় ব্যস্ত রাখেন ডারউইন । অবশেষে ১৮৫৯ সালে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ এর প্রথম সংস্করন প্রকাশিত হয়। পূর্বে উল্লেখিত আমার প্রবন্ধের আবার ও কিছু অংশ তুলে ধরছিঃ


“ডারউইন দেখালেন, নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে এতদিন আমরা যা জেনে এসেছি, তা-ই চরম সত্য নয়। ঈশ্বর নামে কেউ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণি এবং উদ্ভিদকুলকে হঠাৎ করে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাননি। বরং মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভব হয়েছে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির। আপাত বিচারে তাই ভিন্ন হলে ও আসলে সকল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণিসমুহের উৎপত্তি হয়েছে একই প্রকার সরল কোষ থেকে।“



পরাক্রমশালী চার্চ অব ইংল্যান্ড*২ ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বে তুমুলভাবে ক্ষেপে গেল। তাঁরা ডারউইনের বক্তব্যকে ‘ভয়ংকর’, ‘ধর্মদ্রোহিতা’-র সামিল আখ্যা দিল। রক্ষনশীলদের চাপের মুখে ১৮৬০ সালে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ এর দ্বিতীয় সংস্করন প্রকাশের প্রাক্বালে ডারউইন বইটির শেষের দিকে ‘দ্য ক্রিয়েটর’ অর্থাৎ ‘সৃষ্টিকর্তা’ শব্দটি পুনঃসংযোজন করেন। এদিকে ডারউইন মারা যাবার ছয় মাস পরে, ১৮৮২ সালের অক্টোবর মাসে, ডারউইনের ঈশ্বরভীরু স্ত্রী এভা স্বামীর নরকভোগের চিন্তায় শংকিত হয়ে ডারউইনের আত্নজীবনীর কিছু অংশ বাদ দেন। ওখানে ছিল ঈশ্বর কর্তৃক অবিশ্বাসীদের অনাদিকাল ধরে শাস্তিপ্রদানের বিষয়টির প্রতি ডারউইনের কঠোর তিরস্কার। ডারউইনের নাতনি নোরা বারলো ১৯৫৮ সালে দাদীমা কর্তৃক বাদ দেয়া অংশটি দাদার আত্নজীবনীতে পুনঃসংযোজন করেন।



চারঃ

ডারউইন কতটা নাস্তিক কিংবা কতখানি সংশয়বাদী ছিলেন- এটি গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যু নয়। এককালে লালিত বিশ্বাসের সংকীর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে তিনি ওঠে আসতে পেরেছেন; সেখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। নিজের মেধা ও সৃজনশীলতাকে এমন কোন বিশ্বাসের কাছে সমর্পন করতে রাজী হননি যার ভিত্তিমূল সেটি করলে নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। এ রকমই একটা কথা আমেরিকার অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার থমাস জেফারসন ১৭৮৭ সালে পত্রে লিখেছিলেন তাঁর ভাতিজাকে। “সাহসের সাথে প্রশ্ন করার বেলায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে ও পিছু হঠ না, কেননা প্রকৃতই সে রকম কেউ থাকলে তিনি নিশ্চয় অন্ধ ভীতির চেয়ে যুক্তির মনোভাবকেই বেশি পছন্দ করবেন।“



ডারউইন ও তাঁর তত্ত্ব পড়তে এবং বুঝতে এ বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে আমাদের। না হলে পুরো ব্যাপারটা কেবল আস্তিকতা-নাস্তিকতা বালখিল্যতার পর্যায়ে চলে যায়। আর তাতে ডারউইনের পক্ষের বা বিপক্ষের- যে কোন আলোচনাই অসার হতে বাধ্য।

ড. হুমায়ুন আজাদ : নিঃসঙ্গ শেরপা পোস্ট করেছেন : Moderator, জুন 30th, 2009

ড. হুমায়ুন আজাদ : নিঃসঙ্গ শেরপা
রতন কুমার সাহা রায়



আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না; আমি চমৎকার আছি
থাকো উৎসবে, তোমাকে তারাই পাক কাছাকাছি
যারা তোমার আপন; আমি কেউ নই, তোমার গোপন
একান্ত স্বপ্ন; স্বপ্নের ভেতরে কেউ থাকে কতোক্ষন?
বেশ আছি, সুখে আছি; যদিও বিন্দু বিন্দু বিষ
জমে বুকে, শুনি ধ্বনি, বলেছিলে, ’ইশ্ লিবে ডিশ’।
(কষ্ট পেয়ো না, পেরোনোর কিছু নেই-হুমায়ুন আজাদ)


ডঃ হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে আমার পক্ষে লেখা একটি দুরহ ব্যাপার দুটো কারণে, প্রথমতো আমি তাঁর একজন একনিষ্ঠ পাঠক এবং ভক্ত, সুতরাং লেখায় যুক্তির চেয়ে ভক্তিরসের আমদানী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যা একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নের পক্ষে একটি প্রধান অন্তরায়। দ্বিতীয় কারণটি হলো তার সমস্ত লেখার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়, সহজভাবে বলতে গেলে, আমি তাঁর অনেক লেখাই বুঝি না। আমার মনে হয় এটি শুধু আমার নয়, যেকোন আজাদ সমালোচকের জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে সৈয়দ শামসুল হকের সাথে হুমায়ুন আজাদের প্রবচন বিষয়ক বির্তক যা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, শামসুর রাহমানকে, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামতে হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর সমস্ত লেখা এবং সাক্ষাৎকার বির্তকিত হয়ে উঠতে থাকে এবং ক্রমশ তিনি ভূষিত হন, প্রথাবিরোধী লেখকের অভিধায়। এই বিরোধীতা কখনো কখনো অশালীন, অশ্রাব্য হয়ে উঠেছিল, হয়ে উঠেছিল একধরনের লেখকের ফ্যাশন।

’নিঃসঙ্গ শেরপা’ শব্দবন্ধটি ডঃ হুমায়ুন আজাদ ব্যবহার করেছিলেন, শামসুর রাহমানের কাজের ব্যাখ্যায় ও বিশ্লেষণে তিনি ঐ বইটিতে শামসুর রাহমানের কাব্যকৌশল ব্যাখ্যার সাথে সাথে, তিরিশের পাঁচ আদিম দেবতারা রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে যে কাব্যধারার সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তী দশকের কবিদের মধ্যে তার প্রভাব, ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি তখন ভেবেছিলেন, শামসুর রাহমান নয় বরং তাঁর জন্যই এই অভিধাটি বেশি প্রযোজ্য হবে? আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস চেতনার জগতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মানুষ, যিনি শ্রদ্ধার চেয়ে, প্রথার চেয়ে যুক্তিকেই মূল্য দিয়েছেন বেশি। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, কোন সৃষ্টিশীল কর্ম যদি মানবিক তথা যৌক্তিক না হয়, তাহলে তা মূল্যহীন এবং অসার। বাংলাদেশে তিনি ছিলেন স্বঘোষিত, নাস্তিক, তিনি আস্থাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলেন সমস্ত প্রথাকে, হয়ে উঠেছিলেন প্রথাবিরোধী, তার সমস্ত বই, প্রবন্ধ, কবিতা সৃষ্টি হয়েছে প্রথাকে অস্বীকার করে, তাঁর প্রবচনগুচ্ছ এদেশের পাঠক সমাজকে করে তুলেছে সচেতন, আবার ভন্ডদের করে তুলেছে ক্রুদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত জীবনকে চেতনাগতভাবে বদলে দিয়েছেন দু’জন লেখক, একজন অবশ্যই ডঃ হুমায়ুন আজাদ এবং অপরজন হলেন ভারতের যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ, তাঁর লেখা “অলৌকিক নয় লৌকিক” সিরিজের মাধ্যমে আর হুমায়ুন আজাদ বদলেছেন, প্রতিনিয়ত, ভেঙ্গেছেন আমার ভেতরের আদিম বিশ্বাস, করেছেন বিজ্ঞানমনস্ক। ডঃ হুমায়ুন আজাদ এদেশের মেধাবী চিন্তাশীল তরুনদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন কাল্ট। তিনি ছিড়ে ফেলেছিলেন এদেশের অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবির মুখোশ, দেখিয়েছিলেন তাঁদের চিন্তা এবং চেতনার দূর্বলতাগুলো, ক্ষমতার প্রতি তাদের লোভ, দলের দালালী করা তাদের পেশা। তিনি কখনো কোন দলের পক্ষে কথা বলেননি। কারণ তার লেখা কোন দলের মুখপাত্র ছিল না। তা ছিল সামাজিক সচেতনা সৃষ্টির জন্য। ডঃ আজাদ ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সবচেয়ে বেশি আক্রমন করেছিলেন বাঙালিকে। এর স্বপক্ষে তার জবাব ছিল, তিনি এই গোত্রেরই মানুষ, তাই এই জাতির কাছে তার প্রত্যাশা অনেক কিন্তু যখন দেখেন বাঙালি অনিবার্যভাবে পতনকেই বেছে নিচ্ছে তখন তিনি তার সমালোচনা করেন। একটি বিশুদ্ধ পবিত্র বাঙলাদেশ চেয়েছিলেন তিনি যে দেশে কোন স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা ফতোয়া দেবে না, যে দেশে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না সেই দেশটিতে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মৌলবাদীরা স্বপ্নকে সত্যি হতে দেয়নি। তাকে হত্যার মধ্য দিযে, মৌলবাদীরা প্রমাণ করল এদেশে তারা যা চায় তাই হয়। হ্যা, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ডঃ আজাদের মৃত্যু কোন আকস্মিক ঘটনা নয় একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

হুমায়ুন আজাদের জন্ম হয়েছিল ১৩৫৪ সালের ১৪ই বৈশাখ, ইংরেজী ১৯৪৭ এর ২৮শে এপ্রিল। গ্রামটি খুব বিখ্যাত কারণ ঐ গ্রামেই বাড়ি ছিল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর। গ্রামের নাম রাড়িখাল। যদিও আজাদের জন্ম কামারগাও, নানাবাড়ীতে কিন্তু বাড়িখালকে তিনি জন্মগ্রাম মনে করতেন। গ্রামটি ছিল, পানির গ্রাম, কারণ গ্রামে অনেকগুলো পুকুর ছিল। যা বর্ষাকালে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত আর গ্রামটিকে মনে হতো তার ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার মতো। আসল নাম হুমায়ুন কবীর, লেখার জন্য নাম বদল করেন, পরে শপথ পত্রের মাধ্যমে স্থায়ী করে নেন। তারা ছিলেন তিন ভাই দুই বোন। রাড়িখাল নিয়ে তার একটি রচনা আছে। “রাড়িখাল ঃ ঘুমের ভেতরে নিবিড় শ্রাবণধারা” নামে রাড়িখালের উত্তরে ছিল অড়িয়ল বিল যেটি চৈত্রে ছিল সবুজ, বৈশাখে সোনালী আর বর্ষায় সমুদ্রের মতো। পড়াশুনার শুরু বাড়ীতেই, বাবা বলতেন পড়, পড়. সেই পড়াই তার আজীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কোন বিষয়ই তার অপ্রিয় ছিল না। পিতা ছিলেন একদিকে পোষ্ট মাস্টার অপর দিকে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েননি, দ্বিতীয় শ্রেণী পাস করে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন, স্যার জে.সি. বোস ইনস্টিটিউশনে। এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। কখনোই খুব বেশি বন্ধু ছিল না, কিন্তু একজন বন্ধু থেকেছে সবসময় প্রিয়। স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন শামসুল ইসলাম, যাকে তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ উপন্যাসটি। পড়ার ঘরের সামনে ছিল একটি কদম গাছ। বর্ষায় ফুল ফুটে ওটি রুপসী হয়ে উঠতো। এইট নাইনে পড়ার সময এটিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন যাতে কোন কাহিনী ছিল না, ছিল শুধু রুপের বর্ণনা। প্রথম পড়া উপন্যাস আনোয়ারা। যে দুটি উপন্যাস পাগল হযে পড়েছিলেন সে দুটি হলো শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ ও দত্তা। রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা থেকে মুখস্থ করেছিলেন অজস্র কবিতা। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা লেখার শুরু, কিন্তু প্রথম ছাপা হয়েছিল গদ্য লেখা-কচিকাচার আসর এ। কচুরিফুল ছিল তার চোখে সবচেযে সুন্দর ফুল, বর্ষায় পুঁটি মাছের রুপালী ঝিলিক তার চোখে ছিল অপরুপ সৌন্দর্য। ক্লাস এইটে উঠে প্রথম বিড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন শক্তিমানদের মূল্য না দিয়ে, হয়ে উঠেছিলেন প্রথা বিরোধী। ছোট বেলা থেকেই তিনি সৌন্দর্যকে উপভোগ করেছেন, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে কিশোর কবির দৃষ্টিতে। ক্লাস টেনে উঠে তিনি প্রথম হয়েছিলেন, এটি ছিল তার কাছে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। মেট্টিক পরীক্ষায় সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে ২১তম হয়েছিলেন। একটিই বোর্ড ছিল তখন “ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড” তার পর অনিচ্ছায় ঢাকা কলেজ, বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি যদিও শওকত ওসমান ছাড়া আর কোন শিক্ষকই দাগ কাটতে পারেননি তার মনে। জীবনের সবচেয়ে খারাপ ফল ছিল এটাই দ্বিতীয় শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা। তারপর ১৯৬৪ সালে পারিবারিক প্রতিকুলতা পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলায় বি.এ (অনার্স)এ। বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ আবদুল হাই আবদুল হাই বলেছিলেন, “তুমি আমাদের বিভাগে থাকবে তো” ? অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এ সময় লিখেছেন প্রচুর গদ্য ও পদ্য ভুগেছেন নিঃসঙ্গতায়, কামনায়, ডুবেছেন জ্ঞানে ও শিল্পকলায়। ১৯৬৯-এ এ.এম.এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এই সালেরই আগষ্ট মাসে যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারি মহাবিদ্যালয়ে, তারপর ১৯৭০-এ ফেব্র“য়ারীতে যোগদান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসাবে, ১২ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে। ১৯৭৩ এ কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে চলে যান এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচ.ডি করার জন্য। এ সময় সমস্ত লেখালেখি থেকে দূরে থেকেছেন এ সময় শুধু পড়েছেন, বিয়ার খেয়েছেন, ডিস্কোতে নেচেছেন, রান্না শিখেছেন, বন্ধু রর্বাটের সাথে জীবনানন্দের কবিতা অনুবাদ করেছেন, সুখে থেকেছেন মর্মান্তিক কষ্টে থেকেছেন।

এই বছরেই প্রকাশ পায় তার কবিতার বই “অলৌকিক ইষ্টিমার” ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন সহপাঠী লতিফা কোহিনূরকে, টেলিফোনে। ১৯৭৬ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন Pronominalization in Bengali অভিসন্ধর্বটির জন্য। কিশোর সাহিত্য লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রকাশ।

১৯৭৭ থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন লেখালেখির জগতে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মার চোখের জল, তা বাস্তবে রূপ পায়নি, কিন্তু তার হয়ে কাজ করেছে তার “ব্লাড ব্যাংক” কবিতাটি এটি পোষ্টার হিসাবেও ছাপানো হয়। প্রকাশিত হয় কলকাতার দেশ এবং অমৃতবাজার পত্রিকায়।

হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখার অসুবিধা হচ্ছে তার অনেকগুলো সত্তা এবং প্রতিটি সত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তিনি ভাষা বিজ্ঞানী, ভাষা বিজ্ঞানের মতো দূরুহ কাজটি তিনি করেন অবলিলায় আবার একই সাথে কবিতা সাহিত্য, উপন্যাস লিখেন অনায়াসে। প্রতিটিতেই রয়েছে সৃজনশীলতা ও মননশীলতা যখন তিনি কবিতা বা উপন্যাস লিখেন তখন তার মধ্যে শিল্পী সত্তা প্রকট আর যখন তিনি প্রবন্ধ লেখেন তখন মননশীলতা প্রকট। তিনি সবসময় লিখেছেন সচেতনভাবে, তাই তার লেখার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া, তার লেখায় প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুটে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির লক্ষে।

হুমায়ুন আজাদকে আমার বরাবরই মনে হয়েছে, শামসুর রাহমানের ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো সুপুরুষ। আমার আরও মনে হয়, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম “সাহিত্য শহীদ” যিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে, এগিয়ে গেছেন মৃত্যুর দিকে। তিনি যদি চাইতেন শুধুমাত্র ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে, শুধু ভাষা বিজ্ঞানে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে তাহলে সেটা তিনি পারতেন। সেই ধরনের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা তার মধ্যে ছিল, যার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, বাঙালী ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ সংকল (দুইখন্ড), অর্থবিজ্ঞান, মান বাঙলা ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ এবং সবশেষে বাক্যতত্ত্ব’ যা বাঙলা ভাষায় লিখা একটি অমূল্য, অসাধারণ গ্রন্থ, বাঙালি এই বইয়ের মাধ্যমেই প্রথম পরিচিত হয়, রুপান্তর মূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের সাথে, নোয়াম চোমস্কীর তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে। তার ভাষা বিজ্ঞান চর্চাটি নিরস ছিল না। চমৎকারভাবে তিনি উপস্থাপন করতে পারতেন ভাষিক যেকোন বিষয়বস্তুকে যার প্রমাণ“লাল নীল দীপাবলি” এবং “কতো নদী সরোবর” এ অথবা লিখতে পারতেন অন্য ধরনের লেখা যেমনঃ “আব্বুকে মনে পড়ে”, “ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না”, এর মতো লেখা যা বাঙলা সাহিত্যে বিরল। তাহলে কেন তার সাহিত্য জগতে তাঁর এই বিচ্যুতি? কারণ, তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সমাজকে, সংস্কৃতিকে, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে, সর্বপরি বাংলাদেশের সমগ্র প্রসঙ্গ কাঠামোকে এবং তিনি বুঝেছিলেন এবং বেশ ভালভাবে বুঝেছিলেন যে সবকিছু নষ্টদের অধিকার চলে গেছে, একে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখার কিছু নেই, আর জন্য দায়ী রাজনীতিবিদ এবং মৌলবাদীরা। তাহলে, তিনি কি বুঝে শুনেই এগিয়েগেছেন এবং তার অব্যর্থ শব্দে আক্রমন করেছেন প্রতিপক্ষকে এবং তিনি যে অব্যর্থ তার প্রমাণ ওপর শারিরীক হামলা ও সবশেষে মৃত্যু।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন হুমায়ুন আজাদ মূলত একজন কবি ছিলেন, যদিও তিনি সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন সফলভাবে, কিন্তু তাঁর কবি সত্ত্বাটি কখনো তাকে ত্যাগ করেনি। তাঁর লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় তিনি অতিমাত্রায় শব্দ সচেতন যা একজন কবির অনিবার্যগুণ। তাই তিনি শব্দকেই বেছে নিয়েছিল অব্যর্থ অস্ত্র হিসাবে এবং এখানেও তিনি সফল পুরো মাত্রায়। আরও বলা যায় তার মৃত্যু মাসটি ছিল ফেব্র“য়ারী।

হুমায়ুন আজাদ যে গ্রন্থটির জন্য পাঠক ও অপাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশী পরিচিত তা হলো নারী। নারী হলো তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যার মাধ্যমে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সমালোচিত হন, বিতর্কিত হন, নারী গ্রন্থটি উপভোগ করে পাঠকের হৃদয় নিঙরানো ভালবাসা। গ্রন্থটি নারীবাদী ভাবনার আন্তর্জাতিক ভাষ্য। এ গ্রন্থে আমরা পাই নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব, যা আমাদের দেশে তিনিই প্রথম সূচনা করেন। যদিও এর তত্ত্ব ও উপাত্ত ইউরোপের কিন্তু স্বীকরনে ও বাঙলা ভাষায় তা উপস্থাপনে তার দক্ষতা অসাধারণ। এই বইটির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধদের প্রবল বিরোধীতার সম্মুখীন হন এবং তৎকালীন বি.এন.পি সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে, পরে অবশ্য তা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মাঝখানে চলে যায় কয়েকটি বছর। ডঃ আজাদের নারীবাদের ওপর আরো একটি বই হলো সিমন দ্য বোভোয়ারি সেকেন্ড সেক্স এর বাঙলা অনুবাদ দ্বিতীয় লিঙ্গ। তবে যে বইটি বাঙলা ভাষার পাঠক সমাজকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে, তা হলো “আমার অবিশ্বাস”। ডঃ আহমদ শরীফের মতে এমন গ্রন্থ বাঙলায় আর রচিত হয়নি। বিজ্ঞানের যুগে মধ্যযুগীয় বিশ্বাস, রীতি সংস্কার, প্রথা, ট্যাবু ইত্যাদিকে তিনি প্রচন্ডভাবে আক্রমন করেছেন তার কবিত্বময় ভাষায়, ভন্ডদের দাড় করিয়েছেন যুক্তির কাঠগড়ায়। হুমায়ুন আজাদের মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্কতার আরো একটি উদাহরণ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য। ৫৮ বছর বয়সে ক্লান্তিহীনভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন ৬০টির বেশি গ্রন্থ যার কোনটিও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। মৃত্যু এসে সহসা এই মানুষটির সৃষ্টিশীলতার গতিপথ রুদ্ধ করে দিল।

সময় তাকে ধীর ধীরে পাল্টাচ্ছিল। “আমরা কী এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম” বা “পাকসার জমিন সাদ বাদ”,সময় তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল, এমনটা বলা যাবে না, এর কারণ আরো গভীরে মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব যে, অখন্ড তাই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। তিনি যে, শহীদ হলেন তা তার এই পরিবর্তন এর জন্যই। আর বাঙালাদেশের মৌলবাদীরা যে তাকে অগ্রগণ্য শত্র“ হিসাবে বিবেচনা করল তার কারণ এখানেই।

হুমায়ুন আজাদ এদেশের প্রথম সাহিত্যিক যিনি প্রাণ দিলেন একটি রাষ্ট্রীয় অধিকারের জন্য সেটি হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কতটা সুপরিকল্পিত উপায়ে, একজন সাহিত্যিককে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তার ইতিহাস বোধ হয় বর্তমান সভ্যতায় বিরল। ডঃ আজাদের উপন্যাস “পাক সার জমিন সাদ বাদ”, প্রকাশের পর থেকেই যেখানে পত্রিকায়, মিছিলে মিটিং এ এমনকি সংসদে দাড়িয়ে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচিছল। আজাদ এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্ধিগ্ন ছিলেন এবং সে কথা মুক্তামনাকে জানানও। সেই উদ্বেগই সত্যে পরিণত হলে ২৭ তারিখ (২০০৪, ফেব্র“য়ারী) এ মৌলবাদীরা তাকে আক্রমন করে, তাঁর পবিত্র রক্তে পিচ্ছিল হয়ে উঠে, টি.এস.সি চত্ত্বর, গুরুতর অবস্থায় তাকে সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, ডাক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সেবারের মতো বেঁচে ওঠেন। বাঙলার ছাত্র সমাজ তখন ফুঁসে উঠেছিল, তারা সবাই একসাথে উচ্চারণ করেছিল, “আমাদেরও মেরে ফেল” তাই সরকার অবস্থা বেগতিক দেশে তাকে সিঙ্গাপুরের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেখানে তাকে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান ফিরে এসে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার স্পষ্ট করেই বলেন, “মৌলবাদীরাই আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল”। তাই মৌলবাদীরাও তাকে টেলিফোনে হুমকি দিতে থাকে, এমনকি তার গতিবিধি জানার জন্য তার একমাত্র ছেলে অনন্যকে অপহরণও করা হয়, এই মানসিক অশান্তিতে ডঃ আজাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীকে খোলা চিঠি লেখেন কিন্তু এই পোড়া দেশে তার কথা কে শুনবে বিশেষ করে সরকারের কোলের ওপরেই বসেছিল মৌলবাদের নেতারা। যাই হোক আক্রান্ত হওয়ার বছর দুয়েক আগে জার্মান সরকারের কাছে, হাইনরিশ হাইনের ওপর কাজ করার জন্য একটি অ্যাপ্লিকেশন করেছিলেন, এই অস্বস্তিকর সময়ে জার্মান সরকার তার রিচার্সের জন্য অনুমোদন দেয়। আমার মনে সে সময় একটু চিন্তা উদয় হয়েছিল, ঠিক এ সময়ই কেন তাকে রিসার্চের অনুমোদন দেন? এমনতো নয় যে পেনের ভেতরে মৌলবাদীদের কেউ ছিল, যারা চাইছিল হুমায়ুন আজাদকে দেশের বাইরে আনতে? বিশেষ করে অনন্যর অপহৃত হওয়া, জার্মানী যাওয়ার সময় কোন মৌলবাদী নেতার এয়ারপোর্টে উপস্থিতি, তারপর ডঃ আজাদের আকস্মিক মৃত্যু, এ ঘটনাগুলো কি কিছু মিন করে না? আমি জানি না, আমার এ প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত থেকে যাবে, নাকি সময়ের পরিক্রমায় একদিন তা রেরিয়ে আসবে।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেছেন " অজ্ঞতার অপর নামই হলো ঈশ্বর। মানুষ তার অজ্ঞতাকে সোজাসুজি স্বীকার করতে ভয় পায় তাই ঈশ্বর নামক একটা সম্ব্রান্ত নাম খুজে বের করেছে। ঈশ্বর-বিশ্বাসের অপর কারন মানুষের অসামর্থ্য এবং অসহায়তা।"