"সংগ্রহপাড়া" ভ্রমন করতে আসার জন্য আপনাকে স্বাগতম।

সোমবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০১১

সংগ্রহপাড়া: মুক্তমনা এবং যুক্তিবাদি

সংগ্রহপাড়া: মুক্তমনা এবং যুক্তিবাদি

|সর্বগ্রাসী অপ-‘বাদ’ বনাম একজন আরজ আলী মাতুব্বর এবং…|

science_verses_faith_flowcharts
[জবাবদিহি: প্রায় দুই বছরের বেশি, খুব সম্ভব ফেব্রুয়ারি ২০০৮, তখনও মুক্তমনা বাংলা ব্লগ চালু হয়নি, লেখাটি মেইল করা হয় মুক্তমনা সাইটের ঠিকানায়। যথারীতি প্রকাশও হলো মুক্তমনা সাইটে। কিন্তু একদিন আবিষ্কার করলাম লেখাটা হারিয়ে গেছে সাইট থেকে, কিংবা মুক্তমনা সাইটের কোথাও খুজেঁ পেলাম না দৃশ্যমান অবস্থায়। কিন্তু লেখাটার লিঙ্ক আমার সংরক্ষণেই ছিলো। পরবর্তিতে 'ধর্ম ও বিজ্ঞান, সংঘাত না সমন্বয়' বইটার জন্য লেখা আহ্বান করা হলে আমি সংরক্ষণে থাকা লিঙ্কটা সরবরাহ করি এবং ই-বুকটিতে লেখার লিঙ্ক হিসেবে তা স্থানও পেলো। কিন্তু মুক্তমনা লেখক-পাতার আর্টিক্যাল তালিকায় এই লেখার কোন লিঙ্ক নেই বা তালিকায় গ্রন্থিতও হয়নি। তাই লেখাটার মান যাই হোক, মুক্তমনায় দৃশ্যমান রাখার সুপ্ত ইচ্ছেকে লালন করার নিমিত্তে এবার লেখাটাকে এই ব্লগে রিপোস্ট করে নিলাম। এবার অন্তত পাঠক-দৃষ্টিতে এড়িয়ে গেলেও হারিয়ে যাবে না আশা করি। -রণদীপম বসু]

|সর্বগ্রাসী অপ-‘বাদ’ বনাম একজন আরজ আলী মাতুব্বর এবং…|

দার্শনিক, না শিশু?
শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ছোট্ট শিশুটি হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো- চাঁদটা গোল কেন? আমরা যারা ইতোমধ্যে বড় হয়ে গেছি, প্রশ্ন শুনেই নড়েচড়ে ওঠি। তখন আর ঠিক মনে করতে পারি না- আমরাও কি এমন প্রশ্ন করেছিলাম শৈশবে? সৃষ্টির শুরুতে একান্ত তরল প্রকৃতির মহাজাগতিক একটা বস্তুপিণ্ডের তীব্রগতির ঘুর্ণায়মান অবস্থায় মহাকর্ষের কেন্দ্রাভিগ আর কেন্দ্রাতিগ বলের সম্মিলিত প্রভাবের সাথে অন্যান্য অনুঘটক মিশে বস্তুর আকৃতি প্রকৃতই গোল হয়ে যাবার ধারণাটা যারা প্রশ্ন খুঁজে খুঁজে পেয়ে গেছেন তাদের কথা আলাদা। একটা শিশুর পক্ষে তা বুঝার বা তাকে বুঝানোর প্রেক্ষিতও এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বটা অন্যত্র। আমরা যারা এই চাঁদটাকে গোল দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, পূর্ণিমার চাঁদ তো গোলই। এখানে বিস্ময়ের কী আছে! বিস্ময়ের কিছুই খুঁজে পাই না আমরা। তাই চাঁদ কেন গোল, এটাও যে একটা কৌতূহলী প্রশ্ন হতে পারে সেই বোধটাই মরে গেছে আমাদের। এমন হাজারো লক্ষ অভ্যস্ততার মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে বিস্ময়হীন কৌতূহলহীন এই আমরা আসলে এক প্রশ্নহীন অন্ধধারণার বশংবদ প্রাণীই এখন; জিজ্ঞাসু মানুষ নই; দার্শনিক তো দূরের কথা। ব্যাখ্যাহীন পূর্ব-সংস্কারের গড্ডালিকায় নিমজ্জিত আমাদের সুসভ্য চেহারার ভেতরে অন্তর্গত উপলব্ধিটা যে কতো অন্ধকার কালোয় ডুবে আছে, সেই বোধটুকুও হারিয়ে বসে আছি অধিকাংশেই। এর ফল যা হবার তাই হয়েছে- কোন অনাচারেই আর আশ্চর্য হই না আমরা। অলৌকিক নামে লৌকিক কৌশলজাত কিছু মিথ্যাচার, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং চিরাচরিত প্রথার কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য দিয়ে খাচ্ছি দাচ্ছি ঘুমাচ্ছি আর ফলন বাড়াচ্ছি এক অথর্ব প্রজাতির। অথচ একটু কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলেই প্রত্যেকটা মানুষই হতে পারতো একেক জন সম্ভাব্য লোক-দার্শনিক। প্রশ্ন, কীভাবে?
ভালো দার্শনিক হওয়ার জন্যে একমাত্র যে-জিনিসটি আমাদের প্রয়োজন তা হলো বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা। শিশুদের এই ক্ষমতাটি আছে। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। মাতৃগর্ভে অল্প কটা মাস কাটিয়ে তারা একেবারে নতুন এক বাস্তবতার মধ্যে এসে পড়ে। কিন্তু তারা যখন বড় হয় তখন এই বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি যেন নষ্ট হয়ে যায়। কেন এমনটা হয়?…
একটি সদ্যোজাত শিশু যদি কথা বলতে পারত তাহলে হয়ত যে অসাধারণ বিশ্বে সে এসে পড়েছে সেই বিশ্ব সম্পর্কে কিছু কথা জানাতে পারত। কীভাবে সে চারদিকে তাকায় আর যা কিছু দেখে সেদিকেই কীভাবে কৌতূহলের সঙ্গে হাত বাড়িয়ে দেয় সে, তা তো আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।… কিন্তু শিশুটি ভালো করে কথা শেখার অনেক আগেই এবং দার্শনিকভাবে চিন্তা করতে শেখার অনেক আগেই পৃথিবীটা একটা অভ্যাসে পরিণত হবে তার।… ব্যাপারটা রীতিমত দুঃখজনক… পৃথিবীর ব্যাপারে অতি অভ্যস্ততার কারণে এর সঠিক গুরুত্ব উপলব্ধি করতে যারা অক্ষম হয়ে পড়ে… মনে হয় যেন বড় হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াটি চলার সময় আমরা বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতাটি হারিয়ে ফেলি। আর তাতে করে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কিছু হারিয়ে ফেলি- আর সেই হারিয়ে ফেলা জিনিসটিই ফের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন দার্শনিকেরা। কারণ, আমাদের ভেতরে কোথাও থেকে কিছু একটা বলে ওঠে যে, জীবন এক বিশাল রহস্য। আর ঠিক এই ব্যাপারটিই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম অনেক আগে, যখন এই কথাটি আমরা ভাবতে শিখিনি। আরো সঠিকভাবে বলতে গেলে: দার্শনিক প্রশ্নগুলো আমাদের সবাইকেই ভাবিত করলেও আমরা সবাই কিন্তু দার্শনিক হই না। নানান কারণে বেশিরভাগ লোকই প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডে এমনই বাঁধা পড়ে যায় যে বিশ্ব সম্পর্কে তাদের বিস্ময় এসবের আড়ালে চলে যায়। বাচ্চাদের কাছে এই বিশ্ব আর তার সমস্ত কিছুই নতুন; এমন একটা কিছু যা দেখে বিস্ময় জাগে। বড়োদের কাছে ব্যাপারটা সে-রকম নয়। বিশ্বটাকে বড়োরা একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই ধরে নেয়। ঠিক এই জায়গাটাতেই দার্শনিকেরা এক বিরাট ব্যতিক্রম। একজন দার্শনিক কখনোই এই বিশ্বের ব্যাপারে ঠিক পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন না। তিনি পুরুষ বা নারী যা-ই হোন না কেন, তাঁর কাছে বিশ্বটা খানিকটা অযৌক্তিক বলে ঠেকতে থাকে- মনে হতে থাকে হতবুদ্ধিকর, এমনকী হেঁয়ালিভরা। দার্শনিক আর ছোট্ট শিশুদের মধ্যে তাই একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় খুব মিল। সারা জীবন একজন দার্শনিক একটা শিশুর মতোই স্পর্শকাতর রয়ে যান।’ (সোফির জগৎ / ইয়স্তেন গার্ডার / অনুবাদ: জী এইচ হাবীব) তাই দর্শন সম্ভবত শেখার কোন বিষয় নয়; বরং দার্শনিকভাবে চিন্তা করাটাই শেখার বিষয় হতে পারে।
.
কে হবে প্রশ্নকর্তা?
দার্শনিক চিন্তাসূত্র অনুযায়ী জ্ঞান বা জিজ্ঞাসা বিবেচনায় জগতে চিন্তাশীল সত্ত্বা চার ধরনের হতে পারে-
(এক) যে জানে যে, সে সব জানে
(দুই) যে জানে যে, সে কিছুই জানে না
(তিন) যে জানে না যে, সে সব জানে
(চার) যে জানে না যে, সে কিছুই জানে না।
যে জানে যে, সে সব জানে’ এমন কাল্পনিক সত্ত্বার অস্তিত্ব আদৌ সম্ভব কি না, নিশ্চিতভাবেই তা প্রশ্ন সাপে। এই অসীম মহাবিশ্ব চরাচরে সংখ্যারহিত পরিমাণে বিশাল থেকে অতিক্ষুদ্র এই অনন্ত সংখ্যক বিষয়-বস্তু-ঘটনাপুঞ্জের সৃষ্টি-স্থিতি-ধ্বংশ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াজনিত কার্য-কারণের দৃশ্যমান-অদৃশ্য সম্ভব-অসম্ভব অনন্ত-অনাদি মহাসমীকরণের কল্পনারহিত প্রতিটি একক যুগ্ম গোষ্ঠী বা সামগ্রিক প্রেক্ষিতের প্রেক্ষাপট ধারণ করার মতো কাল্পনিক সত্ত্বার অস্তিত্ব কল্পনাতেও কি সম্ভব? জানার যেমন কোন সীমা নেই, তেমনি সীমাহীন জানার বিষয়টিও যৌক্তিক কারণেই যুক্তিহীন। তাই বলা যেতে পারে- যে জানে যে সে সব জানে, এমন সত্ত্বার অস্তিত্ব কেবল যুক্তিপরম্পরাহীন দার্শনিক কল্প-ধারণা মাত্র।
যে জানে যে, সে কিছুই জানে না’- দর্শনের ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ এটি। এ ক্ষেত্রে যাঁর কথা সর্বাগ্রে চলে আসে তিনি গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস (৪৭০-৩৯৯ খ্রি. পূ.)। সমগ্র দর্শনের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় ব্যক্তিই তিনি। জীবদ্দশায় একটি বাক্যও লেখেন নি । তারপরেও ইউরোপিয় চিন্তা ভাবনার ক্ষেত্রে তাঁর চেয়ে বড় প্রভাব আর কেউ ফেলতে পারেন নি।
আমি কেবল একটা কথাই জানি আর সেটা হলো আমি কিছুই জানি না’- নিজের স্বপক্ষে এ কথাটা বলেই তিনি শুধু প্রশ্ন করে যেতেন, বিশেষ কোনো একটা আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে, যেন তিনি বিষয়টা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। যাদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন তাদের তিনি এমন একটা ধারণা দিতেন যে আসলে তিনি তাদের কাছ থেকে শিখতে চাইছেন। প্রশ্নটাই ছিলো তাঁর যুক্তির ধারালো হাতিয়ার। এই হাতিয়ার দিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে তার যুক্তির দুর্বলতা বা অসারতা বুঝিয়ে দিতেন আর তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে তারা উপলব্ধি করতে সক্ষম হতো কোনটি ন্যায় আর কোনটি অন্যায়।
প্রকৃতপক্ষে জানার স্বপক্ষে বাড়িয়ে দেয়া প্রতিটা কার্যকর ধাপে কৌতূহলী ব্যক্তি মূলত নিজের অজ্ঞানতাকেও আরেক ধাপ চিহ্নিত করার প্রয়াস পান। অর্থাৎ নিত্য নতুন জানার মাধ্যমে নিজের অজ্ঞানতাই খুঁজে বেড়ান তাঁরা। এভাবে নতুন নতুন জ্ঞানে তাঁদের কৌতূহল আরো বেশি করে উৎসাহী হতে থাকে আরো নতুন নতুন জ্ঞানের দিকে। কেননা তিনিই জ্ঞানী যিনি তাঁর অজ্ঞানতাকে আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারই জ্ঞান। জানা-কে আবিষ্কার করেন যত, ততই না-জানা’র বিপুলতা সম্বন্ধে সচকিত ও বিহ্বল হয়ে ওঠেন তাঁরা। তাই, যে জানে যে সে কিছুই জানে না, সে-ই সবচেয়ে জ্ঞানী; জ্ঞান অন্বেষণে জানার অদম্য ইচ্ছাই তাঁকে নিরন্তর প্রশ্নমুখি করে তোলে।
প্রশ্নময় কথোপকথনের মধ্য দিয়ে সক্রেটিস যে শুধু জ্ঞানী’র সংজ্ঞাটাই নির্ধারণ করে দেন তা-ই নয়, উল্টো, মূর্খামীর মুখোশটাও ছিঁড়ে ফেলেন একই যুক্তিতে- যে জানে না যে সে কিছুই জানে না। আমরা অধিকাংশই তো সেই মূর্খের দলে, যারা ভান করে যে তারা অনেক কিছুই জানে; অথচ নিজের কাণ্ডজ্ঞানটাও ব্যবহার করতে জানে না। তারা যে কিছুই জানে না, সেই বোধটাও তাদের নেই। অথচ দর্শনগত সত্যগুলো প্রত্যেকেই বুঝতে পারে স্রেফ যদি তারা তাদের সহজাত কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে যুক্তিবোধটাকে ব্যবহার করে। সহজাত যুক্তি ব্যবহার করার অর্থ হচ্ছে নিজের মনের গভীরে পৌঁছে সেখানে যা আছে তা ব্যবহার করা। নিজে অজ্ঞ সেজে সক্রেটিস লোকজনকে তাদের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করতে বাধ্য করতেন। কিন্তু কুসংস্কারে ডুবে থাকা সমাজের ক্ষমতাসীন প্রাতিষ্ঠানিক মূর্খতা লোকজনের কাণ্ডজ্ঞান ব্যবহার করার সুযোগ দেবে কেন? তাই আড়াই হাজার বছর আগের ক্ষমতাসীন প্রতিষ্ঠান যেমন সক্রেটিসকে বাধ্য করেছিলো হেমলকের তীব্র বিষ পান করতে, তেমনি বহুকাল পরে এসেও আমাদের বরিশালের গণ্ডগ্রামে প্রশ্ন করতে জানা স্বশিক্ষিত এক কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকেও প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে এই তখ্ত প্রতিষ্ঠানই ‘পবিত্র হাজতবাসে’ নিক্ষিপ্ত করে। এতে করে কি প্রশ্ন থেমে গেছে? প্রশ্নের প্রাকৃতিক শক্তিই প্রশ্নকে চিরকাল শক্তিশালী করে রাখে।
তৃতীয় পর্যায়ের যে দার্শনিক সত্ত্বা- যে জানে না যে সে সব জানে, এটাও হেঁয়ালিপূর্ণ একটা দার্শনিক বিভেদ মাত্র। যে জানে, অথচ এ বিষয়টাই সে জানে না- এরকম কাঁঠালের আমসত্বের স্বাদ কল্পনাতেই সম্ভব, বাস্তবে নয়।
অতএব, প্রাথমিকভাবে উপস্থাপিত দার্শনিক সত্ত্বার যে চারটি ধারণা উপস্থাপিত হয়েছে, যুক্তি পরম্পরায় এসে চূড়ান্ত ফলাফলে দাঁড়ায়-
(এক) যে জানে যে, সে সব জানে > একটা অসম্ভব কল্পনা বা কাল্পনিক অস্তিত্ব। (দুই) যে জানে যে, সে কিছুই জানে না > জ্ঞানীর বিজ্ঞতা। (তিন) যে জানে না যে, সে সব জানে > অবাস্তব। (চার) যে জানে না যে, সে কিছুই জানে না > মূর্খের অজ্ঞতা।
অর্থাৎ এই সৃষ্টিজগতে দু’টো সত্ত্বাই কেবল ক্রিয়াশীল। জ্ঞানী আর মূর্খ। জ্ঞানী মাত্রেই তাঁর মধ্যে একটা বিস্ময়বোধসম্পন্ন দার্শনিক সত্ত্বা ক্রিয়াশীল থাকবে। কার্যকারণ ভিত্তিক যুক্তির তীব্র রশ্মি দিয়ে সব কিছুকেই প্রয়োজনীয় বিশ্লেষণে উদ্যোগি থাকেন এঁরা; ন্যায় ও অন্যায়কে পার্থক্য করেন। আর যারা কাণ্ডজ্ঞানহীন অজ্ঞান বা মূর্খ, তাদের দুর্ভাগ্য যে, তারা এটাও জানে না যে তারা মূর্খ! ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করবে কোত্থেকে!
কী সেই প্রশ্ন
বিষয়ের মধ্যে বিষয় খুঁজে না পাওয়াটাই বোধ করি দর্শনের একটি বহুল আলোচিত বিষয় বা চিরায়ত দার্শনিক জটিলতাও। কথাটা হেঁয়ালিপূর্ণ মনে হলেও হাস্যকর নয় কিছুতেই। কেননা চলতে ফিরতে আমরা আমাদের সাদাসিধে যাপন প্রণালীর মধ্যেও এরকম দার্শনিক হাপরে পতিত হই মাঝেমধ্যেই। একটা সংবেদনশীল ও গুরুগম্ভীর বিষয় নিয়ে হয়তো আলোচনা করতে হবে, চিন্তাসূত্র গাথার প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিষয়ের এতো অগুনতি ডালপালা গজিয়ে যায় যে শেষপর্যন্ত কোথা থেকে কীভাবে শুরু করতে হবে তা নির্বাচন করাটাই একটা জটিলতর সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। যেখান থেকে শুরু করলে সুরাহার খুব সুন্দর একটা উপায় হয়তো বের হয়ে আসতে পারতো, সেটা না হয়ে ভুল পথে পা দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্টে পেঁচিয়ে নিজেকে হতবিহ্বল করে তুলছি। হয়তো মাঝপথে ক্ষান্ত দিয়ে ফের পূর্বাবস্থায় ফিরে আসতে হচ্ছে। এবং আবারো ওই একই সমস্যা; কোত্থেকে শুরু করবো? অর্থাৎ অন্বিষ্ট বিষয়ের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান যে অসংখ্য বিষয়ের সমাহার, তা থেকে উপযুক্ত বিষয়টিকে নির্বাচন করা বা তুলে আনাটাই মূলত একটা সম্ভাব্য সহজ প্রক্রিয়ার জটিল প্রারম্ভ-সূচক হয়ে বিভ্রান্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেন এমন হয়? এর যথাযথ উত্তর হয়তো এটাই যে- যথাযথ প্রশ্নটি করতে পারছি না আমরা। কেন পারছি না? হয়তো প্রশ্ন করার উপায়টাই জানা নেই আমাদের, তাই।
জগতের সমস্ত উত্তরই না কি নিহিত থাকে উৎক্ষিপ্ত প্রশ্নের মধ্যেই। বলা হয়ে থাকে যিনি প্রশ্ন করতে জানেন, উত্তর তাঁকেই এসে ধরা দেয়। এবং প্রতিটা উত্তর হয়ে ওঠে ফের আরেকটা প্রশ্নের নিয়ামক সূত্র। এমনি করেই প্রশ্ন-উত্তর-প্রশ্ন-উত্তর-প্রশ্নের এই যে পর্যায়ক্রমিক বুনন প্রক্রিয়া, সেই সূচনা লগ্ন হতে কালক্রমে বয়ে বয়ে মানব-সভ্যতার অবারিত চিন্তা-জগতে তা-ই আজ সর্বব্যপ্ত হয়ে এক দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকেই কি দর্শন বলে? দর্শনের সংজ্ঞা নিরূপনের চাইতে বরং দর্শনের সাথে পরিচিত হওয়াটাই বোধ করি অধিকতর সহজ উপায়।
দর্শনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে দর্শন বিষয়ক কয়েকটি প্রশ্ন করা, অনাদিকাল ধরে যে সব প্রশ্ন করে আসছে মানুষ। এবং সম্ভবত মানুষের আদি দার্শনিক প্রশ্নগুলোর মধ্যে দু’টো প্রশ্নই অত্যন্ত মৌলিক- মানুষ কী, পৃথিবীটা কোথা থেকে এসেছে? কেবল এ দু’টো প্রশ্নই মানব সভ্যতার আদি দর্শনের ভিতটাকে গড়ে দিয়েছিলো বিপুলভাবে। পৃথিবীতে খুব সম্ভব এমন কোন সংস্কৃতি নেই যেখানে এ প্রশ্ন দু’টো উত্থাপিত হয় নি। এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই আদি মানবগোষ্ঠীর কল্পনাশক্তির সৃজনমতায় চমৎকার সব দৃষ্টান্ত হয়ে আছে হাজারো দেব-দেবী বিষয়ক পৌরাণিক কাহিনীর মায়াবী জগৎগুলো। মানুষের কল্পনা-ক্ষমতা যে কতো অফুরন্ত হতে পারে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ পেয়ে যাই আমরা এগুলো পাঠ করলে। এখন প্রশ্ন আসে, কল্পনা কী? সমকালীন বাস্তবতায় যে প্রশ্নের উত্তর সাধারণত মেলে না তাকে কিছু উদ্ভাবনীমূলক ধারণাসৃষ্ট কাহিনী পরম্পরায় সাজিয়ে উত্তর খোঁজার আপাত স্বস্তি-প্রয়াসই কল্পনা। তাহলে প্রশ্ন চলে আসবে, ধারণা কী? এমনি করে সূত্র থেকে সূত্র ধরে একটার পর একটা প্রশ্নের তোরণ পেরিয়ে এক অনির্দিষ্ট তথা অভূতপূর্ব গন্তব্যের দিকে এই যে আপাত অনিশ্চিৎ ছুটে যাওয়া, এটাকে কী বলবো আমরা? কেউ কেউ বলেন ‘যুক্তি’। পৃথিবী কী করে সৃষ্টি হয়েছে? যা ঘটে তার পেছনে কি কোন ইচ্ছা বা অর্থ রয়েছে? মৃত্যুর পরে কি জীবন রয়েছে? কীভাবে জীবন যাপন করা উচিৎ আমাদের? এরকম হাজারো প্রশ্নের সংগতিকে অসংখ্য যুক্তি আর যুক্তিহীনতা দিয়ে যে যার মতো ধারণ করেছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি ভিত্তিক আদি মানবগোষ্ঠীর স্বকল্প গড়া উপাখ্যানগুলো। কালে কালে একদিন সভ্যতার মধ্যযুগে এসে তা থেকেই উৎপত্তি হয়ে গেলো ‘ধর্ম’ নামক বিচিত্র এক জটিল তত্ত্ব বা অদ্ভুত ধারণার। আর তখনি প্রশ্ন ওঠে, ধর্ম কি যৌক্তিক, না অযৌক্তিক?
প্রশ্নের হুমকী
প্রশ্ন কি হুমকী হয় কখনো? হয়; প্রশ্ন হুমকী হয় মিথ্যার কাছে। কেন? মিথ্যার কোন সত্যনিষ্ট ভিত্তি থাকে না। প্রশ্নের শক্তির কাছে মিথ্যার ফানুস টিকতে পারে না, চুপসে যায়। বাইরের চকমকি চেহারার ভেতরে ভিত্তিহীন অবলম্বনগুলো মুহুর্মূহু প্রশ্নের ধাক্কায় ভেঙে গেলে মিথ্যার সৌধটা হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে। তাই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত কোন তত্ত্ব বা মতবাদ সমূহ প্রশ্নকেই বেশি ভয় পায়। তার অস্তিত্বের উপর হুমকী বলে প্রশ্নকারীকেই সে সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে। এসব মিথ্যা-বাদের অনুসারীরা তক্কে তক্কে থাকে প্রশ্নকারীর মুখটাকে রুদ্ধ করে দিতে। তার প্রমাণ সেই সক্রেটিস থেকে শুরু করে লিওনার্দো ব্রুনো, গ্যালিলিও হয়ে আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর এবং হালের হুমায়ুন আজাদ। তাঁদের অপরাধ তাঁরা চলমান ও প্রতিষ্ঠিত মিথ্যা মতবাদকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে মিথ্যা অস্তিত্বে নাড়া দিয়েছেন।
এই যে প্রশ্নকে এতো ভয় তাদের, প্রশ্নের শক্তিটা কী? প্রশ্নের শক্তি হচ্ছে উত্থিত যুক্তি। এটা সেই যুক্তি, যে কোন সীমানা মানে না। সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যে আরোহ ও অবরোহ পদ্ধতির এসিড টেষ্টে গলিয়ে গলিয়ে কার্যের পেছনে কারণ এবং তারও পেছনের সূচনা-বিন্দুকে খুঁজে বের করতে সদা উদ্যত সে পিছপা হয় না। কেবল যুক্তিই তো পারে সব ছিঁড়ে ফেড়ে জগতের সবচেয়ে নির্মম ও মৌলিক প্রশ্ন-দুটো নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে দিতে- কী, এবং কেন?
মানবগোষ্ঠীর সূচনালগ্ন থেকেই প্রাথমিক বিস্ময় নিয়ে সৃষ্টির উৎস খোঁজায় উদ্যোগি হয়েছেন আমাদের বুদ্ধিমান পূর্বসূরিরা, যাঁদেরকে আজ আমরা জ্ঞানী ও দার্শনিক হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকি। জ্ঞানে বিজ্ঞানে অগ্রগামী এসব গুণী দার্শনিক বিজ্ঞানীদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই মানব সভ্যতাকে সেই আদি থেকে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে নিতে ব্রতী হয়েছে। তাই গতকাল পর্যন্ত যে জ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন এসে মানুষের সমকালীন অভিজ্ঞতায় যুক্ত হলো, এই সর্বশেষ অর্জনও পরবর্তি অন্বেষায় হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক সূত্র। এভাবে যে কোন যুগে বা কালে সমকালীন জ্ঞানস্তরই সে সময়ের চিন্তারাজ্যে কোন তত্ত্ব বা মতবাদ প্রচার ও বিশ্লেষণের যৌক্তিক মানদণ্ড হিসেবে গৃহিত হয়েছে।
তাই বিভিন্ন সময়ে জন্ম নেয়া ধর্মতত্ত্বগুলো সে সময়কালের বাস্তবতা ও কল্পনাকেই ধারণ করেছে শুধু। যেহেতু বিজ্ঞানের পথ সর্বদাই চলমান, যৌক্তিক ও পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় তাই বিজ্ঞান সাধারণত কোন পরম সত্যে বিশ্বাসী নয়। বস্তুর ভেতরের কার্যকারণ সম্পর্কের প্রাথমিক ব্যাখ্যাকে বিজ্ঞান প্রথমে হাইপোথিসিস হিসেবেই প্রচার করে। পরবর্তি পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের প্রেক্ষিতে সেটা যাচাই বাছাই হতে হতে এক পর্যায়ে তা বৈজ্ঞানিক সত্যে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ধর্মতত্ত্বে পরীক্ষা নিরীক্ষার কোন বালাই নেই। এটা কেবলই এক যুক্তিহীন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্মগ্রন্থগুলোর কাহিনী বর্ণনায় এর জন্ম বা বর্ণনাকালীন সময়ে বিজ্ঞাননির্ভর সত্যের যেটুকু দেখা পাওয়া যায়, সময়ের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানধর্ম অনুযায়ী পরবর্তিতে তাও হয়তো মিথ্যা হয়ে গেছে নতুবা নতুন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অনড় ধর্ম যেহেতু যুক্তিহীন কিছু বিশ্বাস মাত্র, তাই পরবর্তি বাস্তবতায় এসে ধর্মীয় সত্যগুলো কিছু গাজাখোরি কাহিনীর মতো বিকলাঙ্গ হয়ে গেলেও ধর্মধ্বজাধারীরা সেটাকেই ধ্রুব সত্য জ্ঞানে কতকগুলো অন্ধসংস্কারকে জীবনধারায় মিশিয়ে ‘ইহাই পরম সত্য’ বলে নিজের সাথে সাথে অন্যকেও প্রতারিত করে যাচ্ছেন। ফলে পরবর্তিকালে এসে ধর্মীয় সত্য আর বৈজ্ঞানিক সত্যের মধ্যে বিপরীতমুখি অবস্থান তৈরি হয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায় ধর্ম এখন সত্যের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে নিশ্চিতভাবে। এ প্রসঙ্গে ধর্মীয় সত্য বনাম বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন ও নমূনা পাশাপাশি রেখে নিজস্ব কাণ্ডজ্ঞানটুকু খরচ করে যাচাই করলেই আমাদের কাছে সব পরিষ্কার হয়ে যায়। আর এ কাজটাই বিস্ময়করভাবে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় করে দেখিয়েছেন একান্তই মাটিলগ্ন সাদাসিধে এক স্বশিক্ষিত ব্যক্তি আরজ আলী মাতুব্বর। আমাদের শহুরে-শিক্ষিত ভাষায় তিনি নিতান্তই একজন ব্রাত্যজন। কিন্ত জানার অদম্য কৌতূহলে শিক্ষা দীক্ষা জীবন যাপনে জাগতিক সমস্ত প্রতিকূলতায় আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে থেকেও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে শুধুমাত্র স্বীয় পরিচর্যায় কীভাবে জ্ঞানচেতনায় দার্শনিক বিভার উদ্ভাস ঘটাতে হয়, তা-ই দেখিয়েছেন আমাদের আরজ আলী মাতুব্বর।
চোখ থাকলেই কি চক্ষুষ্মান হয়? প্রাতিষ্ঠানিকতার বড় বড় সার্টিফিকেটধারী তথাকথিত শিক্ষিত জন্মান্ধদের অবিমৃষ্য মূর্খতাকে দূর করার উপায় দেখানো জন্যে তিনি ‘সত্যের সন্ধান’ ও ‘সৃষ্টি রহস্য’ নামের যে দু’টো জাজ্জ্বল্যমান চোখ দান করে গেছেন, তুলনা বিচার হঠকারি হলেও, আমাদের মনে পড়ে যায় সেই সক্রেটিসের কথাই। তাই বুঝি এই আরজ আলী মাতুব্বরকে উদ্দেশ্য করে আরেক পণ্ডিতজন শ্রদ্ধেয় সরদার ফজলুল করিমের আবেগ-সঞ্জাত উক্তি- ‘আমাদের সক্রেটিস’ একটুও বাহুল্য মনে হয় না।
aroj_ali_matubbar
আমাদের লোক-দার্শনিক
আজ থেকে গুনে গুনে একশ’ বছর আগে। রবীন্দ্রনাথ তখনো নোবেল পান নি। সেটা আরো পাঁচ বছর পরের ঘটনা। প্রচারিত জন্মসাল বিবেচনায় বাঙালীর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও বাংলাকাব্যে পাশ্চাত্য আধুনিকতার অন্যতম অগ্রণী-পাণ্ডব কবি জীবনানন্দ দাশ উভয়েই তখন ন’বছরের কিশোর বালক। ঠিক সেই সময়ের সেই অন্ধকার সামাজিক অবস্থায় বরিশালের কোন এক গণ্ডগ্রামে অসহায় মা’কে নিয়ে আট বছর বয়েসী পিতৃহীন নিরক্ষর যে বালকটিকে ‘দশ দুয়ারে সাহায্য’ নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হয়েছে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো সুযোগ যার কখনোই আসবে না এবং পরবর্তী পঞ্চাশ বছরেও যার নামটি উল্লেখযোগ্য হিসেবে কারো মুখেও উচ্চারিত হবে না, তাঁর নাম আরজ আলী মাতুব্বর (Aroj Ali Matubbar) । একান্তই গায়ে-গতরে খেটে খাওয়া অত্যন্ত সাধারণ এক মানুষের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কালের কালরেখায় অসাধারণ মানুষও যেমন সাধারণ হয়ে যায়, আবার খুব সাধারণ মানুষও অসাধারণ হয়ে ওঠে। তেমনি এক অসাধারণ হয়ে ওঠা মানুষের গল্প তাঁর নিজের মুখেই শুনি-
বরিশাল শহরের অদূরে লামচরি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম আমার ৩রা পৌষ, ১৩০৭ সালে। চার বছর বয়সে আমার বাবা মারা যান, ১৩১১ সালে। আমার বাবার বিঘা পাঁচেক কৃষিজমি ও ক্ষুদ্র একখানা টিনের বসতঘর ছিলো। খাজনা অনাদায়হেতু ১৩১৭ সালে আমার কৃষিজমিটুকু নিলাম হয়ে যায় এবং কর্জ-দেনার দায়ে মহাজনরা ঘরখানা নিলাম করিয়ে নেন ১৩১৮ সালে। তখন স্বামীহারা, বিত্তহারা ও গৃহহারা হয়ে মা আমাকে নিয়ে ভাসতে থাকেন অকূল দুঃখের সাগরে। সে সময়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে আমাকে দশ দুয়ারের সাহায্যে। তখন আমাদের গ্রামে কোনোরূপ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিলো না। শরীয়তি শিক্ষা দানের জন্য জনৈক মুন্সি একখানা মক্তব খোলেন তাঁর বাড়িতে ১৩২০ সালে। এতিম ছেলে বলে আমি তাঁর মক্তবে ভর্তি হলাম অবৈতনিকভাবে। সেখানে প্রথম বছর শিক্ষা করলাম স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ তালপাতায় এবং বানান-ফলা কলাপাতায়, কেননা আমার বই-স্লেট কেনার সঙ্গতি ছিলো না। অতঃপর এক আত্মীয়ের প্রদত্ত রামসুন্দর বসুর ‘বাল্যশিক্ষা’ নামক বইখানা পড়ার সময় ছাত্রবেতন অনাদায়হেতু মুন্সি সাহেব মক্তবটি বন্ধ করে দিলেন ১৩২১ সালে। আর এখানেই হলো আমার আনুষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষার সমাপ্তি বা সমাধি।
পড়া-লেখা শেখার প্রবল আগ্রহ আমার ছিলো। কিন্তু কোনো উপায় ছিলো না। পেটের দায়ে কৃষিকাজ শুরু করতে হয় অল্প বয়সেই। আমার বাড়ির পাশে একজন ভালো পুঁথিপাঠক ছিলেন। কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাঁর সাথে পুঁথি পড়তে শুরু করি, বাংলা ভাষা পড়বার কিছুটা ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে এবং উদ্দেশ্য আংশিক সফল হয় জয়গুন, সোনাভান, জঙ্গনামা, মোক্তল হোসেন ইত্যাদি পুঁথি পাঠের মাধ্যমে। এ সময়ে আমার পাড়ার দু’টি ছেলে বরিশালের টাউন স্কুল ও জিলা স্কুলে পড়তো। তাদের পুরোনো পাঠ্যবইগুলো এনে পড়তে শুরু করি ১৩৩৫ সাল থেকে এবং তা পড়ি ১৩৪৩ সাল পর্যন্ত। কেন তা জানি না, সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, ইতিহাস ইত্যাদির চেয়ে বিজ্ঞানের বই ও প্রবন্ধগুলো আমার মনকে আকর্ষণ করতো বেশি। তখন থেকেই আমি বিজ্ঞানের ভক্ত। আমার মা ছিলেন অতিশয় নামাজী-কালামী একজন ধার্মিকা রমণী। এবং তার ছোঁয়াচ লেগেছিলো আমার গায়েও কিছুটা। কিন্তু আমার জীবনের গতিপথ বেঁকে যায় আমার মায়ের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে একটি দুঃখজনক ঘটনায়। ১৩৩৯ সালে মা মারা গেলে আমি মৃত মায়ের ফটো তুলেছিলাম। আমার মাকে দাফন করার উদ্দেশ্যে যে সমস্ত মুন্সি, মৌলবি ও মুসল্লিরা এসেছিলেন, ‘ফটো তোলা হারাম’ বলে মায়ের নামাজে জানাজা ও দাফন করা ত্যাগ করে তাঁরা লাশ ফেলে চলে যান। অগত্যা কতিপয় অমুসল্লি নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মাকে সৃষ্টিকর্তার হাতে সমর্পণ করতে হয় কবরে। ধর্মীয় দৃষ্টিতে ছবি তোলা দূষণীয় হলেও সে দোষে দোষী স্বয়ং আমিই, আমার মা নন। তথাপি কেন যে আমার মায়ের অবমাননা করা হলো, তা ভেবে না পেয়ে আমি বিমূঢ় হয়ে মা’র শিয়রে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেহী আত্মাকে উদ্দেশ করে এই বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, “মা! আজীবন ছিলে তুমি ধর্মের একনিষ্ঠ সাধিকা। আর আজ সেই ধর্মের নামেই হলে তুমি শেয়াল-কুকুরের ভ্যক্ষ। সমাজে বিরাজ করছে এখন ধর্মের নামে অসংখ্য কুসংস্কার। তুমি আমায় আশীর্বাদ করো, আমার জীবনের ব্রত হয় যেন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণ অভিযান। আর সে অভিযান সার্থক করে আমি যেন তোমার কাছে আসতে পারি। তুমি আশীর্বাদ করো মোরে মা, আমি যেন বাজাতে পারি সে অভিযানের দামামা।”
আমি জানি যে, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার দূরীকরণ অভিযানে সৈনিকরূপে লড়াই করবার যোগ্যতা আমার নেই। কেননা আমি পঙ্গু। তাই সে অভিযানে অংশ নিতে হবে আমাকে বাজনাদার রূপে। প্রতিজ্ঞা করেছি যে, সে অভিযানে দামামা বাজাবো। কিন্তু তা পাবো কোথায়? দামামা তৈরির উপকরণ তো আমার আয়ত্তে নেই। তাই প্রথমেই আত্মনিয়োগ করতে হলো উপকরণ সংগ্রহের কাজে।
বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব ও বিবিধ বিষয়ে কিছু কিছু জ্ঞানলাভের উদ্দেশ্যে বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরীর সদস্য হয়ে সেখানকার পুস্তকাদি অধ্যয়ন করতে শুরু করি ১৩৪৪ সাল থেকে। স্বয়ং মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত বলে যদিও ইসলাম ধর্মের মূলতত্ত্ব সম্বন্ধে কিছু কিছু তত্ত্ব জানার সুযোগ ছিলো, কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ, পার্সি, ইহুদি, খ্রীস্টান ইত্যাদি ধর্ম সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই আমার জানার সুযোগ ছিলো না। তাই সেসব ধর্ম সম্বন্ধে কিছু কিছু জানার আগ্রহ নিয়ে পড়তে থাকি বরিশালের শংকর লাইব্রেরী ও ব্যাপ্টিস্ট মিশন লাইব্রেরীর কিছু কিছু বই। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের দর্শন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির সাহেব জানতেন আমার সাধনার উদ্দেশ্য কি। তাই উদ্দেশ্যসিদ্ধির সহায়ক হবে বলে তিনি আমাকে দর্শনশাস্ত্র চর্চা করতে উপদেশ দেন এবং তাঁর উপদেশ ও সহযোগিতায় দর্শনসমুদ্রের বেলাভূমিতে বিচরণ করতে থাকি ১৩৫৪ সাল থেকে। তখন দিন যেতো মাঠে আমার রাত যেতো পাঠে।

মায়ের মৃত্যুর পর থেকে দীর্ঘ ১৮ বছর সাধনার পর কতিপয় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসকে দর্শনের উত্তাপে গলিয়ে বিজ্ঞানের ছাঁচে ঢেলে তার একটি তালিকা তৈরি করছিলাম প্রশ্নের আকারে ১৩৫৭ সালে। এ সময় স্থানীয় গোঁড়া বন্ধুরা আমাকে ধর্মবিরোধী ও নাখোদা (নাস্তিক) বলে প্রচার করতে থাকে এবং আমার দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম ছেড়ে শহর পর্যন্ত। লোক পরম্পরায় আমার নাম শুনতে পেয়ে তৎকালীন বরিশালের লইয়ার ম্যাজিস্ট্রেট ও তাবলিগ জামাতের আমির জনাব এফ. করিম সাহেব সদলে আমার সাথে তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন ১৩৫৮ সালের ১২ই জ্যৈষ্ঠ তারিখে আমার বাড়িতে গিয়ে। সে দিনটি ছিলো রবিবার, সাহেবের ছুটির দিন। তাই তিনি নিশ্চিন্তে আমার সাথে তর্কযুদ্ধ চালান বেলা ১০টা থেকে ২টা পর্যন্ত। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বরিশালে গিয়ে তিনি আমাকে এক ফৌজদারি মামলায় সোপর্দ করেন ‘কম্যুনিস্ট’ আখ্যা দিয়ে। সে মামলায় আমার জবানবন্দি তলব করা হলে উপরোল্লিখিত তালিকার প্রশ্নগুলোর কিছু কিছু ব্যাখ্যা লিখে ‘সত্যের সন্ধান’ নাম দিয়ে তা জবানবন্দিরূপে কোর্টে দাখিল করি তৎকালীন বরিশালের পুলিশ সুপার জনাব মহিউদ্দীন সাহেবের মাধ্যমে, ২৭শে আষাঢ়, ১৩৫৮ সালে (ইং ১২. ৭. ৫১)। ‘সত্যের সন্ধান’-এর পাণ্ডুলিপিখানার বদৌলতে সে মামলায় দৈহিক নিষ্কৃতি পেলাম বটে, কিন্তু মানসিক শাস্তি ভোগ করতে হলো বহু বছর। কেননা তৎকালীন পাকিস্তান তথা মুসলিম লীগ সরকারের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলেন যে, ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা আমি প্রকাশ করতে পারবো না, ধর্মীয় সনাতন মতবাদের সমালোচনামূলক অন্য কোনো বই লিখতে পারবো না এবং পারবো না কোনো সভা-সমিতিতে বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বমত প্রচার করতে। যদি এর একটি কাজও করি, তবে যে কোনো অজুহাতে আমাকে পুনঃ ফৌজদারিতে সোপর্দ করা হবে। অগত্যা কলম-কালাম বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতে হলো ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এভাবে নষ্ট হয়ে গেলো আমার কর্মজীবনের অমূল্য ২০টি বছর।
বাংলাদেশে কুখ্যাত পাকিস্তান সরকারের সমাধি হলে পর ‘সত্যের সন্ধান’ বইখানা প্রকাশ করা হয় ১৩৮০ সালে, রচনার ২২ বছর পর। তারপরে আমার লিখিত বই ‘সৃষ্টি রহস্য’ প্রকাশিত হয় ১৩৮৪ সালে, ‘স্মরণিকা’ ১৩৮৯ সালে এবং ‘অনুমান’ নামের ক্ষুদ্র একখানা পুস্তিকা ১৩৯০ সালে। এ প্রসঙ্গে সভাসীন সুধীবৃন্দকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমার লিখিত যাবতীয় পুস্তক-পুস্তিকাই হচ্ছে আমার মায়ের মৃত্যুদিনে আকাঙ্ক্ষিত ‘দামামা’র অঙ্গবিশেষ। কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, আমি ধর্মের বিরোধিতা করছি। বস্তুত তা নয়। পশু, পাখি, কীট-পতঙ্গ ইত্যাদি সমস্ত জীবের এমনকি জল, বায়ু, অগ্নি ইত্যাদি পদার্থেরও এক একটি ধর্ম আছে। ধর্ম একটি থাকবেই। তবে তার সঙ্গে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার থাকা আমার কাম্য নয়। মানব সমাজে ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিলো মানুষের সার্বিক কল্যাণের জন্যই। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত ধর্মগুলো মানুষের কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই করছে বেশি, অবশ্য জাগতিক ব্যাপারে। ধর্মবেত্তারা সকলেই ছিলেন মানবকল্যাণে আত্মনিবেদিত মহাপুরুষ। কিন্তু তাঁরা তাঁদের দেশ ও কালের বন্ধনমুক্ত ছিলেন না। তাঁদের প্রবর্তিত সেকালের অনেক কল্যাণকর ব্যবস্থাই একালের মানুষের অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই ধর্মীয় সমাজবিধানে ফাটল ধরেছে বহুদিন আগে থেকেই। সুদ আদান-প্রদান, খেলাধুলা, নাচ-গান, সুরা পান, ছবি আঁকা, নারী স্বাধীনতা, বিধর্মীর ভাষা শিক্ষা, জন্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি ধর্মবিরোধী কাজগুলো এখন শুধু রাষ্ট্রীয় সমর্থনপুষ্টই নয়, লাভ করেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশেষত গান, বাজনা, নারী, নাচ ও ছবি – এ পাঁচটির একত্র সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায় সিনেমা, রেডিও এবং টেলিভিশনে। কিন্তু সেসবের বিরুদ্ধে সনাতনপন্থীরা কখনো প্রতিবাদের ঝড় তোলেননি। অথচ প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন ফজলুর রহমান, বযলুর রহমান, আ. র. হ. এনামুল হক, আবুল ফজল প্রমুখ মনীষীগণের দু’কলম লেখায়। কতকটা আমারও।
বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের ফলে ধর্ম হোঁচট খাচ্ছে পদে পদে। কোনো ধর্মের এমন শক্তি নেই যে, আজ ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাতিল করে দেয়, নাকচ করে মর্গানের সমাজতত্ত্ব এবং ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত করে কোপার্নিকাস-গ্যালিলিওর আকাশ তত্ত্ব, নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে। মধ্যযুগে যুগমানবের আসনে সমাসীন ছিলেন তৎকালীন মুনি-ঋষি ও নবী-আম্বিয়ারা। তাঁরা ছিলেন গুণী, জ্ঞানী ও মহৎ চরিত্রের মানুষ, তবে ভাববাদী। তাঁদের আদেশ-উপদেশ পালন ও চরিত্র অনুকরণ করেছেন সেকালের জনগণ এবং তখন তা উচিতও ছিলো। কিন্তু সেই সব মনীষীরা এযুগের মানুষের ইহজীবনের জন্য বিশেষ কিছুই রেখে যাননি, একমাত্র পারলৌকিক সুখ-দুঃখের কল্পনা ছাড়া। এ যুগের যুগমানবের আসনে সমাসীন আছেন – কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা। এঁরা সবাই এযুগের গুণী, জ্ঞানী ও মহৎ চরিত্রের মানুষ। তবে এঁরা হচ্ছেন মুক্তমন, স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ও বাস্তববাদী। এঁদের অবদান ছাড়া এ যুগের কোনো মানুষের ইহজীবনের এক মুহূর্তও চলে না। তাই এঁদের সম্মিলিত মতাদর্শ আমাদের মস্তকে গ্রহণ করা উচিত ভাববাদের আবর্জনার বোঝা ফেলে দিয়ে। বর্তমান যুগে বিজ্ঞানবিরোধী কোনো শিক্ষাই গ্রহণীয় নয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, এঁদের সম্মিলিত মতাদর্শ কি? এক কথায় তার উত্তর হচ্ছে – মানবতা। হয়তো ঐ মানবতাই হবে আগামী দিনের মানুষের আন্তর্জাতিক ধর্ম তথা ‘মানবধর্ম’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সভায় (যে সভাটি কোনো কারণবশত অনুষ্ঠিত হয়নি) পাঠ করার জন্য আরজ আলী মাতুব্বরের লিখিত ভাষণের নির্বাচিত অংশ উদ্ধৃত করা হলো এ জন্যেই যে, আমরা তাঁর ঘটনাবহুল জীবন ও তাঁর গড়ে ওঠা চিন্তাজগতের একটা রূপরেখা এ থেকেই পেয়ে যেতে পারি। তবে তাঁকে বুঝার সাথে সাথে আমাদের নিজেদের জীবন জগৎ ও চলমান অন্ধত্বের স্বনির্মিত দার্শনিক জটিলতা কুটিলতাগুলো বুঝতে হলে তাঁর রচনাবলীর গভীর পাঠ আমাদের জন্য আবশ্যক ও জরুরি বলেই মনে হয়। চোখ থাকলেই যে চক্ষুষ্মান হওয়া যায় না, আরো কিছু থাকতে হয়, সেটাই আরজ আলী মাতুব্বর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। সক্রেটিসের মতোই সেই কঠিন প্রশ্ন-করার উপায় আবারো বাৎলে দিলেন- ‘কেন?’
এবং মৃত্যুর আগে তাঁর চুরাশি বছর বয়সে আরেকটি যে অসাধারণ কাজ করে গেলেন তিনি, তাঁর ভাষ্যেই শুনি- ‘… মৃত্যুর পরে আমার চক্ষুদ্বয় চক্ষুব্যাংকে এবং মরদেহটি বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজে দান করেছি। উদ্দেশ্য – মানবকল্যাণ।’

রবিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১১

ডারউইনের ঈশ্বর

ডারউইনের ঈশ্বর
লিখেছেন: জাহেদ আহমদ | বিভাগ: উদযাপন, ডারউইন দিবস, ধর্ম, বিজ্ঞান, বিবর্তন তারিখ: ১ ফাল্গুন ১৪১৫ (ফেব্রুয়ারি 13th, 2009)
(উৎসর্গ- বন্যা আহমেদকে, “বিবর্তনের পথ ধরে” বইটির মাধ্যমে বাংলা ভাষাভাষীদের পথচলা সুগম করে তুলতে তাঁর অনবদ্য প্রচেষ্টার জন্য।)


একঃ
দূরদর্শনের অতি উৎসাহী গসপেল প্রচারক জিমি সোয়াগার্ট ১৯৮৫ সালে তাঁর দর্শক-শ্রোতাদের বিমোহিত করে ফেলেন একটি ঘোষণার মাধ্যমে। তিনি জানান যে, মৃত্যুশয্যায় ডারউইন পুরোপুরি বদলে গিয়েছিলেন। বিবর্তন বিষয়ে নিজের তত্ত্বকে তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন; এমনকি মারা যাবার পূর্বে একখন্ড বাইবেল চেয়েছিলেন যাতে যীশুর প্রেমে আবার মজতে পারেন। পরে জানা গেল, ওটি ছিল ডাহা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি রটনা। সর্বপ্রথম এই অপপ্রচারের শুরু ১৮৮২ সালে যখন স্যার জেমস হোপ (এডমিরাল অব দ্য ফ্লিট)এর স্ত্রী প্রচার করেন, তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত ডারউইনকে নাকি আফসোস করে বলতে শুনেছেনঃ “আমার বিবর্তনের তত্ত্ব লোকজনকে ওভাবে না জানালেই পারতাম!” এ অপপ্রচারে ক্ষুদ্ধ হন ডারউইনের মেয়ে। তিনি স্পষ্ট করে জানান যে, লেডি হোপ ডারউইনের মৃত্যুশয্যা তো দূরের কথা, কোন অসুস্থতার সময়ই উপস্থিত ছিলেন না। ডারউইনের সাথে তাঁর সাক্ষাত ঘটার সম্ভাবনা ও খুব ক্ষীণ। আর দৈবাতক্রমে তা ঘটে থাকলে ও ডারউইনের ওপর লেডী হোপের কোনই প্রভাব ছিল না। ডারউইনের মেয়ে সকল সংশয় ও বিভ্রান্তি নিরসনে এটা ও বললেন যে, মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কিংবা তার ও আগে, ডারউইন কখনোই নিজের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং মতামতসমূহ পরিত্যাগ করেননি। মারা যাবার পূর্বে ছেলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলেন ডারউইন। তাঁর সর্বশেষ উক্তি ছিল “আমি মৃত্যু নিয়ে এতটুকু ও ভীত নই।“



ধর্ম ও ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের অবস্থান নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল এই যে, জীবদ্দশায় ডারউইন কখনোই নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা দেননি। বিষয়টি চরমপন্থী নাস্তিক এবং বদ্ধমনা বিশ্বাসী- উভয়ের জন্যই খানিকটা অসুবিধার। তাই বলে ধর্ম ও ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের অবস্থান হেয়াঁলিপূর্ণ- এ কথা বলার সুযোগ নেই। পরিণত বয়সে লেখা আত্নজীবনীতে এসব বিষয়ে ডারউইন খোলাখোলি বক্তব্য দিয়েছেন। স্বঘোষিত নাস্তিক না হলে ও পরিণত বয়সে পৌঁছে ডারউইন যে প্রচলিত ধর্মে আস্থা হারিয়েছিলেন, সেটা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। তাঁর আত্নজীবনীর ভাষায়, “চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছার পূর্বপর্যন্ত খৃস্ট ধর্ম আমি মোটে ও পরিত্যাগ করিনি।“ বলাবাহুল্য, ১৮৪৯ সালে ডারউইন চল্লিশ বছরে পা দেন। তবে ধর্মের সাথে বিচ্ছেদ ডারউইনের জন্য মোটে ও সহজ ছিল না এবং সেটা হঠাৎ করে ঘটেনি। মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে পিতা রবার্ট এবং পিতামহ ইরাসমাস-এর খ্যাতি থাকলে ও ডারউইন নিজে প্রথম জীবনে একজন যীশুবিশ্বাসী খৃস্টান ছিলেন। কেম্ব্রিজে তিনি পেলি(Paley)’-র প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন করেন। তখন অবধি তাঁর জীবনে এমন কিছু ঘটেনি যাতে তিনি ঈশ্বর, যীশু বা বাইবেলে অনাস্থা প্রকাশ করতে পারেন। কেম্ব্রিজ থেকে পাশ করার পর তাঁর জীবনের লক্ষ্য স্থির ছিল যে তিনি একজন যাজক হবেন। তাঁর স্ত্রী এভা (রক্ত সম্পর্কে মামাতো বোন) ও ছিলেন ধর্মে গভীরভাবে বিশ্বাসী একজন মানুষ ।



১৮৩১ সালে বাইশ বছরের তরুণ ডারউইন যখন এইচএমএস বিগ্‌ল জাহাজে চড়েন, তখন তাঁর কোন ধারণা ছিল না যে, ঐতিহাসিক এ সমুদ্রযাত্রা কেবল তাঁর নিজের জীবনের মোড় নয়, মানব জাতির নিজেদের ইতিহাস এবং ঈশ্বরের সাথে তাদের সম্পর্কের ভীত- এসব কিছুই নাড়িয়ে দেবে। বিগ্‌লে চড়ার সময় নিত্য ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপাতির মাঝে ডারউইন সাথে নিয়েছিলেন একখন্ড বাইবেল। ধর্ম-দর্শনের প্রশ্নে তখন ও তিনি ছিলেন ঈশ্বরের ‘অমোঘ ও অলংঘনীয়’ বিধানে বিশ্বাসী। তাঁর সে সময়ের সাদামাটা বিশ্বাসের মধ্যে ছিলঃ প্রকৃতিতে সবকিছুর একটা চূড়ান্ত পরিণতির রয়েছে (অর্থাৎ তিনি ছিলেন পরিণতিবাদি); প্রকৃতির অপার লীলার আড়ালে রয়েছে মহাপ্রতিভাবান ও মহাসৃজনশীল কারো হাত (জ্বী-হ্যাঁ, তিনি নিজে ও ছিলেন একদা সৃষ্টিবাদী বা ক্রিয়েশনিস্ট) এবং প্রকৃতির সবকিছু আসলে ঈশ্বরের বিধানেরই প্রমাণ। “বিগলে আরোহন করার পরপর্যন্ত ও আমি ছিলাম খুবই রক্ষনশীল ধরনের। মনে পড়ে জাহেজের বহু অফিসার(যাঁরা নিজেরা ও রক্ষণশীল ছিলেন) আমাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন যখন নৈতিকতা বিষয়ে কোন কোন সময় আমি বাইবেলের বক্তব্যকে প্রশ্নাতীত হিসেবে উদ্ধৃত করতাম“ (ডারউইন আত্নজীবনী)।



দু বছরের সমুদ্রযাত্রা পাঁচ বছরে গিয়ে ঠেকে। ১৮৩৬ সালে বিগ্‌ল যখন ইংল্যান্ডের বন্দরে ফেরত আসে, ডারউইন তখন ১৮০ ডিগ্রী এংগেলে পালটে যাওয়া একজন মানুষ। কি ঘটেছিল বিগ্‌ল যাত্রার পাঁচ বছরে যা ডারউইনকে পুরোপুরি পালটে দিল? এ প্রসঙ্গে আমার লেখা ‘ডারউইন যে ভাবে বিজ্ঞানী হলেন’ প্রবন্ধের কিছু অংশ তুলে ধরছিঃ

বিগ্‌ল জাহাজে পাঁচ দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রাকালীন সময়ে ডারউইন জীবনে প্রথম বারের মত প্রত্যক্ষ করেন পাহাড় ও অন্যান্য ভূ-তাত্ত্বিক বস্তুর গায়ে বিবর্তনগত পরিবর্তনের চিহ¡। বিখ্যাত গেলাপাগস দ্বীপপুঞ্জ (ডারউইন ছিলেন সর্বপ্রথম বিজ্ঞানী যিনি সেই দ্বীপপুঞ্জ ভ্রমণ করেন) থেকে সংগ্রহ করেন হরেক রকমের জীবাশ্ম, ছোট-বড় উদ্ভিদ ও প্রাণির নমুনা। তাঁর সংগৃহীত অনেক জীবাশ্মই ছিল অবলুপ্ত প্রাণিসমুহের এবং ডারউইন জানতে প্রচন্ড আগ্রহী ছিলেন কি কারণে ঐ সব প্রাণি পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ¡ হয়ে গিয়েছে। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন প্রাণিকুলের মধ্যে বিরাজমান অংগসংস্থান ও অন্তর্গত তন্ত্রসমুহের পার্থক্য। বিশাল আকারে আর ও সংগ্রহ করেছিলেন হরেক প্রজাতির ফিংগে পাখি। এ সময় ক্যাপ্টেন ফিজ্‌রয়ের দেয়া চার্লস লিয়েল নামক জনৈক ভূ-তত্ত্ববিদের লেখা ’প্রিন্সিপলস্‌ অব জিওলজি’ বইটি বিশেষভাবে তাঁর অধ্যয়নে কাজে লাগে। ………। দেশে এসে বছরের পর বছর সংগ্রীহিত নমুনা নিয়ে একাগ্রচিত্তে অধ্যয়ন ও গবেষণা চালিয়ে যান ডারউইন। সে সময় তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ থমাস ম্যালথাসের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে শিকারী প্রাণি, দূর্ভিক্ষ ও মহামারীর ভূমিকা সম্পর্কিত তত্ত্ব অবগত ছিলেন এবং এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হন। ভিতরে ভিতরে অধ্যয়ন ও গবেষণা পুরোদমে চালিয়ে গেলে ও বহু বছর চার্লস ডারউইন তাঁর থিওরীর কথা কাউকে জানাননি।“



দুইঃ

বিগ্‌লযাত্রা পরবর্তী সময়ে ডারউইন এ কথা বুঝে গেছেন যে, বাইবেলের জেনেসিসে বর্ণিত সর্বমোট ছয়দিনে ঈশ্বর কর্তৃক পৃথিবী এবং জীবকূল সৃষ্টির কাহিনী ভ্রান্ত। বিষয়টি তাঁর নিজের জন্য ও স্বস্তিকর ছিল না। সারা জীবনের লালিত বিশ্বাসকে চুরমার করে দিল চাক্ষুস ও অনস্বীকার্য প্রমাণপাতি আর উপাত্ত যা তিনি সংগ্রহ করেছেন নিজ হাতে। মোহভংগের বেদনা কাটাতে এ সময় তিনি ডিয়িজম (deism) বা একাত্নবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েন । এ মতবাদে বিশ্বাসীরা ঈশ্বর প্রশ্নে প্রচলিত ধর্মসমূহের গোড়াঁমি ব্যাখ্যাকে অগ্রাহ্য করে চলেন, তথাপি তাঁরা মনে করেন, জগতের ভারসাম্য বা ঐক্যতান কেবলমাত্র দৈব ঘটনার ফল নয়। তবে শেষ অবধি নিজের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’ বা থিওরী অব ন্যাচারাল সিলেকশনের মধ্যেই ডারউইন উত্তর খুঁজে পান সৃষ্টি সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের। ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরী তাঁকে এমন একটি আভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ায় সন্ধান দিল যা একইসাথে জগতের ভারসাম্য ও শৃংখলা তৈরী করতে এবং তা অব্যাহত রাখতে সক্ষম।



আস্তে আস্তে খৃস্ট ধর্ম ও বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বর থেকে ডারউইন নিজেকে গুটিয়ে নেন। ভিতরে ভিতরে বাইবেলে*১ বর্ণিত ঈশ্বরের কঠোর সমালোচক হয়ে ওঠেন তিনি। ঈশ্বর প্রশ্নে ডারউইনের বক্তব্যের সাথে পরবর্তীকালের কৃতি বিজ্ঞানী এবং দার্শনিক আলবার্ট আইন্সটাইনের বক্তব্যের যথেষ্ট মিল পাওয়া যায়। নিজেদের সরাসরি নাস্তিক ঘোষণা না দিলে ও এঁদের দুজনেই এমন কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানতে রাজী হননি যিনি কি-না সর্বশক্তিমান এবং সর্বাধিক দয়ালু অথচ নির্দেশ অমান্যকারী (যেমনঃ সংশয়ী, অবিশ্বাসী) সৃষ্টিকূলকে তিনি কঠিন, ভয়াবহ এবং নির্মম নরকযন্ত্রণা দিতে পছন্দ করেন। তথাকথিত অলৌকিকত্ব বা মিরাকলে ও এঁদের আস্থা ছিল না। তবে ধর্ম ও ঈশ্বর প্রসংগে ডারউইনের বক্তব্য কেবল বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বিবর্তনের আলোকে তিনি ধর্ম ও ঈশ্বর বিশ্বাসের ভিত্তি খোঁজার চেষ্টা করেন। বাইবেলের Old Testament এ বর্ণিত পাষাণ ও নিষ্ঠুর ঈশ্বর এবং নৈতিকতা বিষয়ে খৃস্টান ধর্মের যে ব্যাখ্যা- ডারউইনের মতে এ সব বিশ্বাস হচ্ছে মানুষের আদিম সত্ত্বার শেষ চিহ্ন। জীবের বাঁচার সংগ্রাম, কষ্ট, ভোগান্তির কারণ ও অস্তিত্বের ব্যাখ্যা ‘সর্বদয়ালু এবং সর্বশক্তিমান’ কোন বিধাতার স্থলে নৈতিক বিচারে অন্ধ প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার সাথেই বেশি মানানসই। তাঁর মতে, ধর্মের ইতিহাস স্বয়ং একটি বিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। প্রাণিদের পর্যবেক্ষন করে ডারউন তাদের মধ্যে কিছু সর্বপ্রাণবাদী (animist) আচরনের অস্তিত্ব লক্ষ করলেন যাকে তিনি ধর্মবিশ্বাসের এক প্রকার আদিম প্রকাশ বলে মত ব্যক্ত করেন। ডারউইন বিশ্বাস করতেন, নৈতিকতার মত ধর্ম ও বিবর্তনের একটি প্রোডাক্ট বা সৃষ্টি মাত্র ; ঐশী বাণী ব্যতিরেকে ও ধর্মের ধাপসমূহ এবং বিধিমালার পুনর্সন্ধান এবং পুনরাবিষ্কার সম্ভব।





তিনঃ

ধর্ম, নৈতিকতা এবং ঈশ্বর বিষয়ে ডারউইনের মনোজগতে এসব দৃষ্টিভংগিসমূহের উদ্ভব এবং বিকাশ ঘটেছিল খুবই ধীর গতিতে এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত আত্নজীবনীতে ডারউইন কথাটি বলেন এ ভাবেঃ “(ধর্মে) অবিশ্বাসের বীজ আমার মধ্যে খুবই ধীরগতিতে অংকুরিত হতে থাকে, তবে শেষের দিকে সেটা পূর্ণতা পায়।“ জীবদ্দশায় ধর্ম-ঈশ্বর নিয়ে প্রকাশ্যে যে কোন বাক-বিতন্ডা তিনি এড়িয়ে চলতেন। এর অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে- ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ বইটি প্রকাশের আগেভাগেই ইংল্যান্ডের রক্ষনশীল খৃস্টানদের বিরাগভাজন হতে চাননি তিনি। এ ছাড়া ঘরে তাঁর স্ত্রী এভা ছিলেন ধর্মবিশ্বাসে সম্পূর্ণ অন্য মেরুর মানুষ। তবে স্ত্রীর নিজের মত করে বিশ্বাসের অধিকারকে ডারউইন শ্রদ্ধা করে গেছেন জীবনভর। যা হোক, দীর্ঘ দুই যুগের ও বেশি সময় ধরে নিজেকে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ রচনায় ব্যস্ত রাখেন ডারউইন । অবশেষে ১৮৫৯ সালে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ এর প্রথম সংস্করন প্রকাশিত হয়। পূর্বে উল্লেখিত আমার প্রবন্ধের আবার ও কিছু অংশ তুলে ধরছিঃ


“ডারউইন দেখালেন, নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে এতদিন আমরা যা জেনে এসেছি, তা-ই চরম সত্য নয়। ঈশ্বর নামে কেউ মানুষসহ অন্যান্য প্রাণি এবং উদ্ভিদকুলকে হঠাৎ করে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাননি। বরং মিলিয়ন মিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক ও পরিবেশগত পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভব হয়েছে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির। আপাত বিচারে তাই ভিন্ন হলে ও আসলে সকল প্রজাতির উদ্ভিদ এবং প্রাণিসমুহের উৎপত্তি হয়েছে একই প্রকার সরল কোষ থেকে।“



পরাক্রমশালী চার্চ অব ইংল্যান্ড*২ ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বে তুমুলভাবে ক্ষেপে গেল। তাঁরা ডারউইনের বক্তব্যকে ‘ভয়ংকর’, ‘ধর্মদ্রোহিতা’-র সামিল আখ্যা দিল। রক্ষনশীলদের চাপের মুখে ১৮৬০ সালে ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ এর দ্বিতীয় সংস্করন প্রকাশের প্রাক্বালে ডারউইন বইটির শেষের দিকে ‘দ্য ক্রিয়েটর’ অর্থাৎ ‘সৃষ্টিকর্তা’ শব্দটি পুনঃসংযোজন করেন। এদিকে ডারউইন মারা যাবার ছয় মাস পরে, ১৮৮২ সালের অক্টোবর মাসে, ডারউইনের ঈশ্বরভীরু স্ত্রী এভা স্বামীর নরকভোগের চিন্তায় শংকিত হয়ে ডারউইনের আত্নজীবনীর কিছু অংশ বাদ দেন। ওখানে ছিল ঈশ্বর কর্তৃক অবিশ্বাসীদের অনাদিকাল ধরে শাস্তিপ্রদানের বিষয়টির প্রতি ডারউইনের কঠোর তিরস্কার। ডারউইনের নাতনি নোরা বারলো ১৯৫৮ সালে দাদীমা কর্তৃক বাদ দেয়া অংশটি দাদার আত্নজীবনীতে পুনঃসংযোজন করেন।



চারঃ

ডারউইন কতটা নাস্তিক কিংবা কতখানি সংশয়বাদী ছিলেন- এটি গুরুত্বপূর্ণ কোন ইস্যু নয়। এককালে লালিত বিশ্বাসের সংকীর্ণতা এবং সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে তিনি ওঠে আসতে পেরেছেন; সেখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব। নিজের মেধা ও সৃজনশীলতাকে এমন কোন বিশ্বাসের কাছে সমর্পন করতে রাজী হননি যার ভিত্তিমূল সেটি করলে নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। এ রকমই একটা কথা আমেরিকার অন্যতম ফাউন্ডিং ফাদার থমাস জেফারসন ১৭৮৭ সালে পত্রে লিখেছিলেন তাঁর ভাতিজাকে। “সাহসের সাথে প্রশ্ন করার বেলায় ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে ও পিছু হঠ না, কেননা প্রকৃতই সে রকম কেউ থাকলে তিনি নিশ্চয় অন্ধ ভীতির চেয়ে যুক্তির মনোভাবকেই বেশি পছন্দ করবেন।“



ডারউইন ও তাঁর তত্ত্ব পড়তে এবং বুঝতে এ বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে আমাদের। না হলে পুরো ব্যাপারটা কেবল আস্তিকতা-নাস্তিকতা বালখিল্যতার পর্যায়ে চলে যায়। আর তাতে ডারউইনের পক্ষের বা বিপক্ষের- যে কোন আলোচনাই অসার হতে বাধ্য।

ড. হুমায়ুন আজাদ : নিঃসঙ্গ শেরপা পোস্ট করেছেন : Moderator, জুন 30th, 2009

ড. হুমায়ুন আজাদ : নিঃসঙ্গ শেরপা
রতন কুমার সাহা রায়



আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না; আমি চমৎকার আছি
থাকো উৎসবে, তোমাকে তারাই পাক কাছাকাছি
যারা তোমার আপন; আমি কেউ নই, তোমার গোপন
একান্ত স্বপ্ন; স্বপ্নের ভেতরে কেউ থাকে কতোক্ষন?
বেশ আছি, সুখে আছি; যদিও বিন্দু বিন্দু বিষ
জমে বুকে, শুনি ধ্বনি, বলেছিলে, ’ইশ্ লিবে ডিশ’।
(কষ্ট পেয়ো না, পেরোনোর কিছু নেই-হুমায়ুন আজাদ)


ডঃ হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে আমার পক্ষে লেখা একটি দুরহ ব্যাপার দুটো কারণে, প্রথমতো আমি তাঁর একজন একনিষ্ঠ পাঠক এবং ভক্ত, সুতরাং লেখায় যুক্তির চেয়ে ভক্তিরসের আমদানী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যা একজন লেখকের সৃষ্টিশীলতার মূল্যায়নের পক্ষে একটি প্রধান অন্তরায়। দ্বিতীয় কারণটি হলো তার সমস্ত লেখার অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার নয়, সহজভাবে বলতে গেলে, আমি তাঁর অনেক লেখাই বুঝি না। আমার মনে হয় এটি শুধু আমার নয়, যেকোন আজাদ সমালোচকের জন্য প্রাসঙ্গিক। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে সৈয়দ শামসুল হকের সাথে হুমায়ুন আজাদের প্রবচন বিষয়ক বির্তক যা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, শামসুর রাহমানকে, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় নামতে হয়। শুধু তাই নয়, তাঁর সমস্ত লেখা এবং সাক্ষাৎকার বির্তকিত হয়ে উঠতে থাকে এবং ক্রমশ তিনি ভূষিত হন, প্রথাবিরোধী লেখকের অভিধায়। এই বিরোধীতা কখনো কখনো অশালীন, অশ্রাব্য হয়ে উঠেছিল, হয়ে উঠেছিল একধরনের লেখকের ফ্যাশন।

’নিঃসঙ্গ শেরপা’ শব্দবন্ধটি ডঃ হুমায়ুন আজাদ ব্যবহার করেছিলেন, শামসুর রাহমানের কাজের ব্যাখ্যায় ও বিশ্লেষণে তিনি ঐ বইটিতে শামসুর রাহমানের কাব্যকৌশল ব্যাখ্যার সাথে সাথে, তিরিশের পাঁচ আদিম দেবতারা রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে যে কাব্যধারার সৃষ্টি করেছিলেন, পরবর্তী দশকের কবিদের মধ্যে তার প্রভাব, ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করেছিলেন। কিন্তু তিনি কি তখন ভেবেছিলেন, শামসুর রাহমান নয় বরং তাঁর জন্যই এই অভিধাটি বেশি প্রযোজ্য হবে? আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস চেতনার জগতে তিনিই ছিলেন একমাত্র মানুষ, যিনি শ্রদ্ধার চেয়ে, প্রথার চেয়ে যুক্তিকেই মূল্য দিয়েছেন বেশি। তিনি স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন, কোন সৃষ্টিশীল কর্ম যদি মানবিক তথা যৌক্তিক না হয়, তাহলে তা মূল্যহীন এবং অসার। বাংলাদেশে তিনি ছিলেন স্বঘোষিত, নাস্তিক, তিনি আস্থাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলেন সমস্ত প্রথাকে, হয়ে উঠেছিলেন প্রথাবিরোধী, তার সমস্ত বই, প্রবন্ধ, কবিতা সৃষ্টি হয়েছে প্রথাকে অস্বীকার করে, তাঁর প্রবচনগুচ্ছ এদেশের পাঠক সমাজকে করে তুলেছে সচেতন, আবার ভন্ডদের করে তুলেছে ক্রুদ্ধ। আমার ব্যক্তিগত জীবনকে চেতনাগতভাবে বদলে দিয়েছেন দু’জন লেখক, একজন অবশ্যই ডঃ হুমায়ুন আজাদ এবং অপরজন হলেন ভারতের যুক্তিবাদী সমিতির সম্পাদক প্রবীর ঘোষ, তাঁর লেখা “অলৌকিক নয় লৌকিক” সিরিজের মাধ্যমে আর হুমায়ুন আজাদ বদলেছেন, প্রতিনিয়ত, ভেঙ্গেছেন আমার ভেতরের আদিম বিশ্বাস, করেছেন বিজ্ঞানমনস্ক। ডঃ হুমায়ুন আজাদ এদেশের মেধাবী চিন্তাশীল তরুনদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন কাল্ট। তিনি ছিড়ে ফেলেছিলেন এদেশের অনেক তথাকথিত বুদ্ধিজীবির মুখোশ, দেখিয়েছিলেন তাঁদের চিন্তা এবং চেতনার দূর্বলতাগুলো, ক্ষমতার প্রতি তাদের লোভ, দলের দালালী করা তাদের পেশা। তিনি কখনো কোন দলের পক্ষে কথা বলেননি। কারণ তার লেখা কোন দলের মুখপাত্র ছিল না। তা ছিল সামাজিক সচেতনা সৃষ্টির জন্য। ডঃ আজাদ ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি সবচেয়ে বেশি আক্রমন করেছিলেন বাঙালিকে। এর স্বপক্ষে তার জবাব ছিল, তিনি এই গোত্রেরই মানুষ, তাই এই জাতির কাছে তার প্রত্যাশা অনেক কিন্তু যখন দেখেন বাঙালি অনিবার্যভাবে পতনকেই বেছে নিচ্ছে তখন তিনি তার সমালোচনা করেন। একটি বিশুদ্ধ পবিত্র বাঙলাদেশ চেয়েছিলেন তিনি যে দেশে কোন স্বাধীনতা বিরোধী থাকবে না। ধর্মব্যবসায়ীরা ফতোয়া দেবে না, যে দেশে ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না সেই দেশটিতে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মৌলবাদীরা স্বপ্নকে সত্যি হতে দেয়নি। তাকে হত্যার মধ্য দিযে, মৌলবাদীরা প্রমাণ করল এদেশে তারা যা চায় তাই হয়। হ্যা, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি ডঃ আজাদের মৃত্যু কোন আকস্মিক ঘটনা নয় একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

হুমায়ুন আজাদের জন্ম হয়েছিল ১৩৫৪ সালের ১৪ই বৈশাখ, ইংরেজী ১৯৪৭ এর ২৮শে এপ্রিল। গ্রামটি খুব বিখ্যাত কারণ ঐ গ্রামেই বাড়ি ছিল বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর। গ্রামের নাম রাড়িখাল। যদিও আজাদের জন্ম কামারগাও, নানাবাড়ীতে কিন্তু বাড়িখালকে তিনি জন্মগ্রাম মনে করতেন। গ্রামটি ছিল, পানির গ্রাম, কারণ গ্রামে অনেকগুলো পুকুর ছিল। যা বর্ষাকালে পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠত আর গ্রামটিকে মনে হতো তার ওপর ভাসতে থাকা কচুরিপানার মতো। আসল নাম হুমায়ুন কবীর, লেখার জন্য নাম বদল করেন, পরে শপথ পত্রের মাধ্যমে স্থায়ী করে নেন। তারা ছিলেন তিন ভাই দুই বোন। রাড়িখাল নিয়ে তার একটি রচনা আছে। “রাড়িখাল ঃ ঘুমের ভেতরে নিবিড় শ্রাবণধারা” নামে রাড়িখালের উত্তরে ছিল অড়িয়ল বিল যেটি চৈত্রে ছিল সবুজ, বৈশাখে সোনালী আর বর্ষায় সমুদ্রের মতো। পড়াশুনার শুরু বাড়ীতেই, বাবা বলতেন পড়, পড়. সেই পড়াই তার আজীবনের সঙ্গী হয়ে উঠেছিল। কোন বিষয়ই তার অপ্রিয় ছিল না। পিতা ছিলেন একদিকে পোষ্ট মাস্টার অপর দিকে গ্রামের স্কুলের শিক্ষক। তিনি তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েননি, দ্বিতীয় শ্রেণী পাস করে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন, স্যার জে.সি. বোস ইনস্টিটিউশনে। এটি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। কখনোই খুব বেশি বন্ধু ছিল না, কিন্তু একজন বন্ধু থেকেছে সবসময় প্রিয়। স্কুলের প্রিয় শিক্ষক ছিলেন শামসুল ইসলাম, যাকে তিনি উৎসর্গ করেছেন ‘শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার’ উপন্যাসটি। পড়ার ঘরের সামনে ছিল একটি কদম গাছ। বর্ষায় ফুল ফুটে ওটি রুপসী হয়ে উঠতো। এইট নাইনে পড়ার সময এটিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন যাতে কোন কাহিনী ছিল না, ছিল শুধু রুপের বর্ণনা। প্রথম পড়া উপন্যাস আনোয়ারা। যে দুটি উপন্যাস পাগল হযে পড়েছিলেন সে দুটি হলো শরৎচন্দ্রের গৃহদাহ ও দত্তা। রবীন্দ্রনাথের চয়নিকা থেকে মুখস্থ করেছিলেন অজস্র কবিতা। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবিতা লেখার শুরু, কিন্তু প্রথম ছাপা হয়েছিল গদ্য লেখা-কচিকাচার আসর এ। কচুরিফুল ছিল তার চোখে সবচেযে সুন্দর ফুল, বর্ষায় পুঁটি মাছের রুপালী ঝিলিক তার চোখে ছিল অপরুপ সৌন্দর্য। ক্লাস এইটে উঠে প্রথম বিড়ি খাওয়ার অভিজ্ঞতা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি বড় হয়ে উঠেছেন শক্তিমানদের মূল্য না দিয়ে, হয়ে উঠেছিলেন প্রথা বিরোধী। ছোট বেলা থেকেই তিনি সৌন্দর্যকে উপভোগ করেছেন, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে কিশোর কবির দৃষ্টিতে। ক্লাস টেনে উঠে তিনি প্রথম হয়েছিলেন, এটি ছিল তার কাছে একটি সাড়া জাগানো ঘটনা। মেট্টিক পরীক্ষায় সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানে ২১তম হয়েছিলেন। একটিই বোর্ড ছিল তখন “ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারী এডুকেশন বোর্ড” তার পর অনিচ্ছায় ঢাকা কলেজ, বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি যদিও শওকত ওসমান ছাড়া আর কোন শিক্ষকই দাগ কাটতে পারেননি তার মনে। জীবনের সবচেয়ে খারাপ ফল ছিল এটাই দ্বিতীয় শ্রেণীতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা। তারপর ১৯৬৪ সালে পারিবারিক প্রতিকুলতা পেরিয়ে তিনি ভর্তি হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাঙলায় বি.এ (অনার্স)এ। বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ আবদুল হাই আবদুল হাই বলেছিলেন, “তুমি আমাদের বিভাগে থাকবে তো” ? অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এ সময় লিখেছেন প্রচুর গদ্য ও পদ্য ভুগেছেন নিঃসঙ্গতায়, কামনায়, ডুবেছেন জ্ঞানে ও শিল্পকলায়। ১৯৬৯-এ এ.এম.এ প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, এই সালেরই আগষ্ট মাসে যোগ দেন চট্টগ্রাম সরকারি মহাবিদ্যালয়ে, তারপর ১৯৭০-এ ফেব্র“য়ারীতে যোগদান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক হিসাবে, ১২ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে। ১৯৭৩ এ কমনওয়েলথ বৃত্তি পেয়ে চলে যান এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পিএইচ.ডি করার জন্য। এ সময় সমস্ত লেখালেখি থেকে দূরে থেকেছেন এ সময় শুধু পড়েছেন, বিয়ার খেয়েছেন, ডিস্কোতে নেচেছেন, রান্না শিখেছেন, বন্ধু রর্বাটের সাথে জীবনানন্দের কবিতা অনুবাদ করেছেন, সুখে থেকেছেন মর্মান্তিক কষ্টে থেকেছেন।

এই বছরেই প্রকাশ পায় তার কবিতার বই “অলৌকিক ইষ্টিমার” ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন সহপাঠী লতিফা কোহিনূরকে, টেলিফোনে। ১৯৭৬ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন Pronominalization in Bengali অভিসন্ধর্বটির জন্য। কিশোর সাহিত্য লাল নীল দীপাবলী বা বাঙলা সাহিত্যের জীবনী প্রকাশ।

১৯৭৭ থেকে তিনি পুরোপুরি প্রবেশ করেন লেখালেখির জগতে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু মার চোখের জল, তা বাস্তবে রূপ পায়নি, কিন্তু তার হয়ে কাজ করেছে তার “ব্লাড ব্যাংক” কবিতাটি এটি পোষ্টার হিসাবেও ছাপানো হয়। প্রকাশিত হয় কলকাতার দেশ এবং অমৃতবাজার পত্রিকায়।

হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে লেখার অসুবিধা হচ্ছে তার অনেকগুলো সত্তা এবং প্রতিটি সত্তাই গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে তিনি ভাষা বিজ্ঞানী, ভাষা বিজ্ঞানের মতো দূরুহ কাজটি তিনি করেন অবলিলায় আবার একই সাথে কবিতা সাহিত্য, উপন্যাস লিখেন অনায়াসে। প্রতিটিতেই রয়েছে সৃজনশীলতা ও মননশীলতা যখন তিনি কবিতা বা উপন্যাস লিখেন তখন তার মধ্যে শিল্পী সত্তা প্রকট আর যখন তিনি প্রবন্ধ লেখেন তখন মননশীলতা প্রকট। তিনি সবসময় লিখেছেন সচেতনভাবে, তাই তার লেখার প্রক্রিয়াটি হচ্ছে একটি যৌক্তিক প্রক্রিয়া, তার লেখায় প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ ছুটে যায় অভীষ্ট সিদ্ধির লক্ষে।

হুমায়ুন আজাদকে আমার বরাবরই মনে হয়েছে, শামসুর রাহমানের ঝাকড়া চুলের বাবরি দোলানো সুপুরুষ। আমার আরও মনে হয়, তিনি বাংলাদেশের অন্যতম “সাহিত্য শহীদ” যিনি অত্যন্ত সচেতন ভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে, এগিয়ে গেছেন মৃত্যুর দিকে। তিনি যদি চাইতেন শুধুমাত্র ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে, শুধু ভাষা বিজ্ঞানে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে তাহলে সেটা তিনি পারতেন। সেই ধরনের মননশীলতা ও সৃষ্টিশীলতা তার মধ্যে ছিল, যার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, বাঙালী ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ সংকল (দুইখন্ড), অর্থবিজ্ঞান, মান বাঙলা ভাষা বিষয়ক প্রবন্ধ এবং সবশেষে বাক্যতত্ত্ব’ যা বাঙলা ভাষায় লিখা একটি অমূল্য, অসাধারণ গ্রন্থ, বাঙালি এই বইয়ের মাধ্যমেই প্রথম পরিচিত হয়, রুপান্তর মূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণের সাথে, নোয়াম চোমস্কীর তত্ত্ব ও তথ্যের সাথে। তার ভাষা বিজ্ঞান চর্চাটি নিরস ছিল না। চমৎকারভাবে তিনি উপস্থাপন করতে পারতেন ভাষিক যেকোন বিষয়বস্তুকে যার প্রমাণ“লাল নীল দীপাবলি” এবং “কতো নদী সরোবর” এ অথবা লিখতে পারতেন অন্য ধরনের লেখা যেমনঃ “আব্বুকে মনে পড়ে”, “ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না”, এর মতো লেখা যা বাঙলা সাহিত্যে বিরল। তাহলে কেন তার সাহিত্য জগতে তাঁর এই বিচ্যুতি? কারণ, তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশের সমাজকে, সংস্কৃতিকে, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে, সর্বপরি বাংলাদেশের সমগ্র প্রসঙ্গ কাঠামোকে এবং তিনি বুঝেছিলেন এবং বেশ ভালভাবে বুঝেছিলেন যে সবকিছু নষ্টদের অধিকার চলে গেছে, একে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখার কিছু নেই, আর জন্য দায়ী রাজনীতিবিদ এবং মৌলবাদীরা। তাহলে, তিনি কি বুঝে শুনেই এগিয়েগেছেন এবং তার অব্যর্থ শব্দে আক্রমন করেছেন প্রতিপক্ষকে এবং তিনি যে অব্যর্থ তার প্রমাণ ওপর শারিরীক হামলা ও সবশেষে মৃত্যু।

এখানে মনে রাখা প্রয়োজন হুমায়ুন আজাদ মূলত একজন কবি ছিলেন, যদিও তিনি সাহিত্যে বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন সফলভাবে, কিন্তু তাঁর কবি সত্ত্বাটি কখনো তাকে ত্যাগ করেনি। তাঁর লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায় তিনি অতিমাত্রায় শব্দ সচেতন যা একজন কবির অনিবার্যগুণ। তাই তিনি শব্দকেই বেছে নিয়েছিল অব্যর্থ অস্ত্র হিসাবে এবং এখানেও তিনি সফল পুরো মাত্রায়। আরও বলা যায় তার মৃত্যু মাসটি ছিল ফেব্র“য়ারী।

হুমায়ুন আজাদ যে গ্রন্থটির জন্য পাঠক ও অপাঠকের কাছে সবচেয়ে বেশী পরিচিত তা হলো নারী। নারী হলো তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। যার মাধ্যমে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন। সমালোচিত হন, বিতর্কিত হন, নারী গ্রন্থটি উপভোগ করে পাঠকের হৃদয় নিঙরানো ভালবাসা। গ্রন্থটি নারীবাদী ভাবনার আন্তর্জাতিক ভাষ্য। এ গ্রন্থে আমরা পাই নারীবাদী সাহিত্যতত্ত্ব, যা আমাদের দেশে তিনিই প্রথম সূচনা করেন। যদিও এর তত্ত্ব ও উপাত্ত ইউরোপের কিন্তু স্বীকরনে ও বাঙলা ভাষায় তা উপস্থাপনে তার দক্ষতা অসাধারণ। এই বইটির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধদের প্রবল বিরোধীতার সম্মুখীন হন এবং তৎকালীন বি.এন.পি সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষনা করে, পরে অবশ্য তা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মাঝখানে চলে যায় কয়েকটি বছর। ডঃ আজাদের নারীবাদের ওপর আরো একটি বই হলো সিমন দ্য বোভোয়ারি সেকেন্ড সেক্স এর বাঙলা অনুবাদ দ্বিতীয় লিঙ্গ। তবে যে বইটি বাঙলা ভাষার পাঠক সমাজকে বড় রকমের ধাক্কা দিয়েছে, তা হলো “আমার অবিশ্বাস”। ডঃ আহমদ শরীফের মতে এমন গ্রন্থ বাঙলায় আর রচিত হয়নি। বিজ্ঞানের যুগে মধ্যযুগীয় বিশ্বাস, রীতি সংস্কার, প্রথা, ট্যাবু ইত্যাদিকে তিনি প্রচন্ডভাবে আক্রমন করেছেন তার কবিত্বময় ভাষায়, ভন্ডদের দাড় করিয়েছেন যুক্তির কাঠগড়ায়। হুমায়ুন আজাদের মুক্তবুদ্ধি ও বিজ্ঞানমনস্কতার আরো একটি উদাহরণ ধর্মানুভূতির উপকথা ও অন্যান্য। ৫৮ বছর বয়সে ক্লান্তিহীনভাবে তিনি সৃষ্টি করেছেন ৬০টির বেশি গ্রন্থ যার কোনটিও অগুরুত্বপূর্ণ নয়। মৃত্যু এসে সহসা এই মানুষটির সৃষ্টিশীলতার গতিপথ রুদ্ধ করে দিল।

সময় তাকে ধীর ধীরে পাল্টাচ্ছিল। “আমরা কী এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম” বা “পাকসার জমিন সাদ বাদ”,সময় তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছিল, এমনটা বলা যাবে না, এর কারণ আরো গভীরে মানুষের সামাজিক অস্তিত্ব ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব যে, অখন্ড তাই তার দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল। তিনি যে, শহীদ হলেন তা তার এই পরিবর্তন এর জন্যই। আর বাঙালাদেশের মৌলবাদীরা যে তাকে অগ্রগণ্য শত্র“ হিসাবে বিবেচনা করল তার কারণ এখানেই।

হুমায়ুন আজাদ এদেশের প্রথম সাহিত্যিক যিনি প্রাণ দিলেন একটি রাষ্ট্রীয় অধিকারের জন্য সেটি হলো মত প্রকাশের স্বাধীনতা। কতটা সুপরিকল্পিত উপায়ে, একজন সাহিত্যিককে এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেয়া যায় তার ইতিহাস বোধ হয় বর্তমান সভ্যতায় বিরল। ডঃ আজাদের উপন্যাস “পাক সার জমিন সাদ বাদ”, প্রকাশের পর থেকেই যেখানে পত্রিকায়, মিছিলে মিটিং এ এমনকি সংসদে দাড়িয়ে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার কথা বলা হচিছল। আজাদ এ বিষয়ে যথেষ্ট উদ্ধিগ্ন ছিলেন এবং সে কথা মুক্তামনাকে জানানও। সেই উদ্বেগই সত্যে পরিণত হলে ২৭ তারিখ (২০০৪, ফেব্র“য়ারী) এ মৌলবাদীরা তাকে আক্রমন করে, তাঁর পবিত্র রক্তে পিচ্ছিল হয়ে উঠে, টি.এস.সি চত্ত্বর, গুরুতর অবস্থায় তাকে সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়, ডাক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি সেবারের মতো বেঁচে ওঠেন। বাঙলার ছাত্র সমাজ তখন ফুঁসে উঠেছিল, তারা সবাই একসাথে উচ্চারণ করেছিল, “আমাদেরও মেরে ফেল” তাই সরকার অবস্থা বেগতিক দেশে তাকে সিঙ্গাপুরের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেখানে তাকে পাঠানো হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখান ফিরে এসে বিভিন্ন সাক্ষাৎকার স্পষ্ট করেই বলেন, “মৌলবাদীরাই আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিল”। তাই মৌলবাদীরাও তাকে টেলিফোনে হুমকি দিতে থাকে, এমনকি তার গতিবিধি জানার জন্য তার একমাত্র ছেলে অনন্যকে অপহরণও করা হয়, এই মানসিক অশান্তিতে ডঃ আজাদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলীয় নেত্রীকে খোলা চিঠি লেখেন কিন্তু এই পোড়া দেশে তার কথা কে শুনবে বিশেষ করে সরকারের কোলের ওপরেই বসেছিল মৌলবাদের নেতারা। যাই হোক আক্রান্ত হওয়ার বছর দুয়েক আগে জার্মান সরকারের কাছে, হাইনরিশ হাইনের ওপর কাজ করার জন্য একটি অ্যাপ্লিকেশন করেছিলেন, এই অস্বস্তিকর সময়ে জার্মান সরকার তার রিচার্সের জন্য অনুমোদন দেয়। আমার মনে সে সময় একটু চিন্তা উদয় হয়েছিল, ঠিক এ সময়ই কেন তাকে রিসার্চের অনুমোদন দেন? এমনতো নয় যে পেনের ভেতরে মৌলবাদীদের কেউ ছিল, যারা চাইছিল হুমায়ুন আজাদকে দেশের বাইরে আনতে? বিশেষ করে অনন্যর অপহৃত হওয়া, জার্মানী যাওয়ার সময় কোন মৌলবাদী নেতার এয়ারপোর্টে উপস্থিতি, তারপর ডঃ আজাদের আকস্মিক মৃত্যু, এ ঘটনাগুলো কি কিছু মিন করে না? আমি জানি না, আমার এ প্রশ্নগুলো অমীমাংসিত থেকে যাবে, নাকি সময়ের পরিক্রমায় একদিন তা রেরিয়ে আসবে।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন বলেছেন " অজ্ঞতার অপর নামই হলো ঈশ্বর। মানুষ তার অজ্ঞতাকে সোজাসুজি স্বীকার করতে ভয় পায় তাই ঈশ্বর নামক একটা সম্ব্রান্ত নাম খুজে বের করেছে। ঈশ্বর-বিশ্বাসের অপর কারন মানুষের অসামর্থ্য এবং অসহায়তা।"